mother holding baby's leg symbol of love

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর, কষ্টের এক প্রহর পার করে, অবশেষে বহুল আকাঙ্খিত ছোট্ট অতিথির মুখ দেখতে পেলে কি আর নিজের নাওয়া খাওয়ার কথা খেয়াল থাকে! কিন্তু যত কষ্টই হোক একজন মাকে নিজের খেয়াল রাখতেই হবে, আর তা আদরের সন্তানের ভালোর জন্যই। ক্ষুদে মানুষটার জন্য মায়ের বুকের দুধই তো একমাত্র খাবার, মা ঠিকমতো না খেলে, মা ও সন্তান দুজনেরই থেকে যাবে পুষ্টির ঘাটতি। 

বুকের দুধ বা ব্রেস্টমিল্ক এ প্রায় সব কিছুই আছে যা একটা শিশুর জীবনের প্রথম ছয় মাসে দরকার। কিন্তু যদি মায়ের খাদ্যগ্রহণ যথেষ্ট ও যথাযথ না হয় তাহলে প্রথমে দুধের পুষ্টিমানের উপর প্রভাব পরবে, অতঃপর সন্তানের উপর। দুধের পুষ্টি উপাদানগুলো কিন্তু পরিবর্তনশীল। যেমন, জন্মের পরপর একরকম দুধের ঘনত্ব, কয়মাস পরে আবার অন্যরকম। আবার ফিডিং করানোর একদম শুরুতে তরল বেশি থাকলেও, এরপরে ভারী হয়ে যায়। বলাই বাহুল্য, মায়ের প্রতিবেলার খাবারের সাথেও দুধের পুষ্টিমানের উনিশ বিশ হয়।

ব্রেস্টফিডিং মায়ের পুষ্টি চাহিদা 

ব্রেস্টফিডিং মায়ের অন্যান্য নারীদের তুলনায় চাহিদা বেশি। নিজের দেহের ক্ষয়পূরণ এবং সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে এই অতিরিক্ত খাবার দরকার। নিজেই দেখে নিন, কোন উপাদানের বাড়তি চাহিদা কত-

পুষ্টি উপাদানসাধারণ নারীর চাহিদাব্রেস্টফিডিং মায়ের চাহিদা
শক্তি (kcal)২০০০২৫০০
প্রোটিন (g)৪৬৭১
ভিটামিন এ (μg)৭০০১৩০০
আয়রন (mg)১৮
ফলিক এসিড (μg)৪০০৫০০
আয়োডিন (μg)১৫০২৯০
ক্যালসিয়াম (mg)৮০০১০০০
জিঙ্ক (mg)১২
ভিটামিন বি১২ (μg)২.৪২.৮

ক্যালরি

সন্তান জন্মদানের পর প্রথম ছয় মাস দৈনিক ৭৫০ মিলি ব্রেস্টমিল্ক তৈরি হয়, যা প্রায় ৫২০ কিলোক্যালরি শক্তির জোগান দেয়। যদি মায়ের খাবার থেকে এই বাড়তি ক্যালরি না আসে, তাহলে তার শরীরে জমাকৃত ফ্যাট ভেঙ্গে এই শক্তি আসবে। তাই বলে দ্রুত ওজন কমাতে কম খাওয়া যাবে না প্রথম দিকেই, তাতে দুধের পরিমাণ কমে যেতে পারে। পরবর্তী ৩-৬ মাসে ওজন আপনা আপনি কমতে থাকবে। তাই প্রথম ছয় মাস স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত ৫০০ কিলোক্যালরি এবং পরে ৪০০  কিলোক্যালরি খেতে হবে। 

আধ কাপ ভাত কিংবা একটি রুটি থেকে ৭০ কিলোক্যালরি চলে আসে। সেই মত হিসাব করে খেতে হবে। অনেকে এই সময়ে বেশি চিনি দেয়া বা ভাজাপোড়া খাবার খেয়ে ফেলেন মনের সুখে, কিন্তু তা কখনোই করা উচিত না। চিনি থেকে খালি কিছু ক্যালরি, আর কোন পুষ্টিই আসবে না। আর ভাজাপোড়া খেলে তো হজমে সমস্যা কষ্ট হবে, মা আর শিশুর দুজনেরই।

প্রোটিন 

এ সময়ে প্রতিদিন প্রায় ২৫ গ্রাম বেশি প্রোটিনের প্রয়োজন হয়। এজন্য মাকে প্রতিদিন মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল, দুধ ইত্যাদি খেতে হবে। সাধারণত ২ গ্রাম খাদ্য প্রোটিন থেকে ১ গ্রাম দুধের প্রোটিন তৈরি হয়। এটি তখনই সম্ভব মায়েরা যদি দৈনিক ১০০ গ্রাম প্রোটিনের মধ্যে অর্ধেক বা দু-তৃতীয়াংশ প্রাণিজ প্রোটিন যেমন- মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি গ্রহণ করেন। প্রাণিজ প্রোটিন মায়ের দুধের উৎকৃষ্ট উপাদান। 

ছবিতে দেখুন, এদেশের বুকের দুধ খাওয়ানো বা প্রসূতি মায়েদের দৈনিক কোন খাবার সর্বনিম্ন কতটুকু খেতে হবে, তা দেখানো হয়েছে।

minimum required food intake for mother in Bangladesh

সূত্র: আইসিডিডিআর, বি

ক্যালসিয়াম

দুধে প্রচুর ক্যালসিয়াম থাকে আমরা জানি। ব্রেস্টমিল্ক তৈরিতেও তাই এটা খুব জরুরি। বিশেষ করে প্রথম ছয় মাস ১০০০ মিলিগ্রাম করে করে ক্যালসিয়াম খাওয়া দরকার। প্রতিদিন ৫০০ মিলি দুধ, প্রচুর সবুজ শাক-সবজি, কাঁটা সহ ছোট মাছ ইত্যাদি খেলে এই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। 

অন্যান্য পুষ্টি উপাদান

ব্রেস্টমিল্ক এর প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান গুলোকে দুইটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়- ১. যা মায়ের খাবারের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল, ২. যা মায়ের খাবারের উপর নির্ভরশীল না, খাবার থেকে না আসলে মায়ের শরীর এগুলোর জোগান দিবে। 

আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, দ্বিতীয় গ্রুপের উপাদান গুলোর জন্য তো মায়ের খাদ্যাভাস জরুরী না। কিন্তু না, মায়ের শরীর থেকে প্রতিনিয়ত এই উপাদান গুলো বের হয়ে যেতে থাকলে কিছুদিন পর মা নিজেই এগুলোর অভাবে অসুস্থ হয়ে যাবে। তাই এগুলোর প্রয়োজনীয়তাও কম না। 

নিচের চার্ট থেকেই দেখে নিন, কোন পুষ্টি উপাদান কোন শ্রেণীতে পড়েছে আর সেগুলোর উৎস কি কি-

পুষ্টি উপাদানউৎস
শ্রেণী ১ঃ (মায়ের খাবারের উপর নির্ভরশীল)
ভিটামিন বি১মাছ, বাদাম, বীজ, শস্য জাতীয় খাবার
ভিটামিন বি২ডিম, মাংস, কলিজা, বাদাম, দুধ, পনির
ভিটামিন বি৬কলা, মুরগির মাংস, বীজ, মা্‌ দই
ভিটামিন বি১২কলিজা, সামুদ্রিক মাছ, চিংড়ি, দুধ
কোলিনডিম, কলিজা, বাদাম 
ভিটামিন এরঙিন সবজি, ফল, সবুজ শাক, ডিম
ভিটামিন ডিতেল, বাদাম, বীজ, মাছ
সেলেনিয়ামবাদাম, বীজ, সামুদ্রিক মাছ, গম
আয়োডিনসামুদ্রিক মাছ, আয়োডিনযুক্ত লবণ
শ্রেণী ২ঃ (মায়ের খাবারের উপর নির্ভরশীল না)
ফলেটডাল, সবুজ শাকসবজি, বীজ
ক্যালসিয়ামদুধ, পনির, ডাল, শাক, ছোট মাছ
আয়রনসবুজ শাকসবজি, মাংস, কলিজা, শিম
জিঙ্কমাংস, বাদাম, দুধ, শিম জাতীয় খাবার

সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, প্রতিদিন সুষম খাবার পরিমাণমত খেলেই এই উপাদানগুলোর চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।

সাপ্লিমেন্ট

কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তাররা খাবারের পাশাপাশি সাপ্লিমেন্ট নেয়ার পরামর্শ দেন। যেমন-

  • খাবারে অরুচি, বদহজম, বমিভাব ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিলে মাল্টিভিটামিন দেয়া হয়, যাতে কোন ভিটামিনের অভাব না হয়।
  • ওমেগা-৩ (DHA) হল শিশুর ব্রেইনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। খাবার থেকে না পাওয়ার আশঙ্কা থাকলে এর সাপ্লিমেন্ট দেয়া হয়।
  • ভিটামিন ডি ব্রেস্টমিল্ক এ খুব কম থাকে, তাই শিশুদের এর ড্রপ দেয়া হয়।
  • আবার ব্রেস্টমিল্ক বাড়াতে অনেক সময় সাপ্লিমেন্ট প্রয়োজন হয়, যেগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি।

পর্যাপ্ত পানি

ব্রেস্টমিল্ক তৈরিতে প্রচুর পানি প্রয়োজন। সাধারণত শরীরই জানান দেয়, কখন পানি খেতে হবে। শিশু যখন দুধ খাওয়া শুরু করে তখন অক্সিটোসিন হরমোন প্রবাহিত হয়, যা পিপাসার উদ্রেক করে। তাই পিপাসা পেলেই পানি খেতে হবে। কখনো খুব ক্লান্ত বোধ হলে, দুধের প্রবাহ কম মনে হলে, প্রশ্রাবের ঘনত্ব ও রং বেশি মনে হলে মায়ের উচিত পানি পানের পরিমান বাড়িয়ে দেয়া।

যেসব খাবারে ব্রেস্টমিল্ক বাড়ে

কিছু খাবার আছে যাদের বলা হয় ব্রেস্টফিডিং ‘সুপার ফুড’, কারণ এগুলো দুধের প্রবাহ বাড়াতে সাহায্য করে। এই খাবার গুলোর উদাহরণ হল- 

  • ওটস, বার্লি: প্রচুর ফাইবার, ভিটামিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ; বুকের দুধের পরিমাণ বাড়ানোর সাথে সাথে শরীরে চর্বি ভাঙতে সাহায্য করে ও রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে হার্টকে ভালো রাখে।
  • শাক সবজি: গাজর, বিট, পেঁপে ইত্যাদি রঙিন ফল ও সবজি হল  ক্যারোটিনয়েডস সমৃদ্ধ আর সবুজ শাকসবজি হল  মিনারেলে ভরপুর। এগুলো ব্রেস্টমিল্ক তৈরি হতে সাহায্য করে। 
  • সামুদ্রিক মাছ: দুধের পরিমান বৃদ্ধি করে, সেইসাথে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড থাকায় শিশুর জন্য খুব দরকারি।
  • মেথি, তিল: এগুলো খেলে দুধের উৎপাদন বাড়বে।

যেসব খাবারে ব্রেস্টমিল্ক কমে

কিছু কিছু খাবার আবার মায়েদের খেতে বারণ করা হয়, যেমন-

  • চা-কফি: এসবে যে ক্যাফেইন থাকে তা শিশুর হজম করতে কষ্ট হয়, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়, আবার দুধের পরিমাণ ও কমিয়ে দেয়।
  • টক ফলমূল: এগুলো গ্যাস ও এসিডিটির উদ্রেক করতে পারে। 
  • কিছু সবজি: বাধাকপি, ফুলকপি, মুলা, টমেটো, কাঁচা পেঁয়াজ ইত্যাদি শিশুর পেটে গ্যাস তৈরি করতে পারে। সবার ক্ষেত্রেই যে হবে, এমনটা না।
  • কিছু মশলা, মরিচ ও রসুন: এগুলো খাওয়ার পর ফিডিং করালে যদি শিশু দুর্বল হয়ে যায় ও ঢেঁকুর তুলতে থাকে তাহলে খাওয়া কমিয়ে ফেলতে হবে।
  • গরুর দুধ: অনেক শিশু প্রথমে দুধে এলার্জিক থাকে, তাই কিছুদিন খাওয়া বন্ধ রাখতে হবে। পরে আবার খেয়ে দেখা যেতে পারে। আবারও এলার্জি দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।  

কিছু সুঅভ্যাস

শুধু কি খাদ্যাভ্যাস? নিজের আর সন্তানের সুস্বাস্থ্যের জন্য আরো অনেক দিকেই খেয়াল রাখতে হবে-

  • পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম: ছোট বাচ্চা থাকলে এ দুটোর ঘাটতি কিছু হবেই, তবু চেষ্টা করতে হবে টাইম ম্যানেজ করার। সন্তানকে কিছুক্ষন খেয়াল করার জন্য বাসার কারো সাহায্য নিতে পারেন। 
  • স্ট্রেস ও টেনশান: এ দুটি ও অবশ্যম্ভাবী। বাচ্চাকে নিজের কাছে রাখলে খুব খাটনি হয়, আবার অন্য কাউকে দিলে শুরু হয় টেনশান। তাই সন্তানকে অন্যের কাছে দিয়েও চোখে চোখে রাখবেন। নিজে হাঁটাহাঁটি করবেন, হালকা ব্যায়াম করবেন, তাহলে শরীর ভালো  থাকবে।
  • কিছু ওষুধ বুকের দুধ একদম কমিয়ে দেয়, যেমন- জন্মবিরতিকরণ পিল, সর্দির ওষুধ ইত্যাদি। তাই ঠান্ডা জ্বর যাই আসুক না কেন, ডাক্তারের পরামর্শ না নিয়ে ওষুধ খাওয়া যাবে না। চেষ্টা করতে হবে এসব থেকে বেঁচে থাকার জন্য। হুটহাট ঠান্ডা কিছু খাওয়া, বার বার গোসল করা বা এরকম কোন অনিয়ম করা যাবে না।
  • পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে একটু বেশি নজর দিতে হবে মাকে। না হলে ছোট্ট মানুষটার নানান অসুখ হতে পারে।

মায়ের কাজ শুধু সন্তান জন্ম দিয়েই ফুরিয়ে যায় না, বরং সেখান থেকেই শুরু হয় আসল দায়িত্ব। তবে জন্মের পর থেকে শুরু করে পরের দুবছরের পুষ্টি ওর পুরো ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর এ সময়ে ওকে দুধপান করানো মায়ের নিজের পুষ্টি যে অনেক জরুরি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সবার আগে একজন মায়ের নিজেকে সুস্থ থাকতে হবে, সব নিয়ম মেনে চলতে হবে। তাহলেই না পাওয়া যাবে মাতৃত্বের আসল স্বাদ।

লেখাটি রিভিউ করেছেন –

ডাঃ সাবরিনা আফরোজ
MBBS, MPH
লেকচারার, ঢাকা কমিউনিটি মেডিসিন কলেজ

সম্পাদনায়ঃ হাবিবা মুবাশ্বেরা