আমাদের দেশে শীতকাল বেশ অল্প সময়ের জন্য আসে।এর ব্যাপ্তিকাল সাধারণত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত হয়। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শহর অঞ্চলগুলোতে শীতের তীব্রতা ততটা অনুভূত না হলেও গ্রামাঞ্চলে শীতের বেশ প্রভাব এখনো লক্ষ্যণীয়।

এই সময় মা ও শিশুদের বেশ ভাল রকমের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। নতুবা ঋতু বদলের সাথে সাথে তারা শীতের শুরুতেই জ্বর, সর্দি-কাশিসহ নানা ধরনের অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়।

বাচ্চাদের যত্ন

বাচ্চাদের রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা তুলনামূলক ভাবে একটু দুর্বল হয়। তাই রোগাক্রান্ত হবার আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া উত্তম। বাচ্চাদের শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কিছু কৌশল অবলম্বন করা যায়।

১.এক বছরের বেশি বয়সী বাচ্চা হলে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর মধু মেশানো গরম পানি দেওয়া যেতে পারে , সাথে দু’এক ফোঁটা আদার রস। মধু এবং আদার রসে ঠান্ডা ,কফ- কাশির জন্য বেশ উপকার পাওয়া যায়।

২. বাচ্চাদের সব সময় হালকা কুসুম গরম পানি খাওয়ানো উচিত। এজন্য প্রয়োজন বোধে সার্বক্ষণিকভাবে একটি ফ্লাক্সে গরম পানি রাখা যায়। শীতে ঠান্ডার জন্য বাচ্চাদের পানি খাওয়ার প্রবণতা অনেক কমে যায়, যা তাদের শরীরের জন্য ভালো না। কিন্তু এভাবে কুসুম গরম পানি খেতে দিলে বাচ্চাদের চাহিদামত পানি খাওয়ানো যাবে।

৩. বাসায় থাকাকালীন সময়ে বাচ্চাদের মোজা বা স্যান্ডেল পরানো। যাদের ঠান্ডার সমস্যা বেশি তাদের জন্য মোজা পরে স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে থাকা বেশ উপকারী। ফ্লোরের ঠান্ডা মাটিতে হাঁটলে সর্দি-কাশি বেড়ে যেতে পারে।

৪. ফুলস্লিভ জামা বা পাতলা সোয়েটার পরে থাকলে তাদের জন্য আরামদায়ক হবে। বাহিরে বের হলে অবশ্যই পর্যাপ্ত গরম কাপড়, মাফলার, টুপি, মোজা, হাত মোজা পরিয়ে বাচ্চাদের বের করা উচিত।

৫. যেসব বাচ্চা মাত্র হামাগুড়ি দেয়, শীতকালটা তাদের জন্য তূলনামূলক বেশি বিপদজনক। এ বয়সে বাচ্চারা কোলে থাকতে চায় না । তারা মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াতে চায়। সেক্ষেত্রে তাদের ভারী পাজামা, মোজা ও হাত মোজা পরিয়ে মাটিতে ছাড়া উচিত। সম্ভব হলে বাচ্চার হামাগুড়ি দেওয়ার জায়গা গুলোতে কার্পেট বিছাতে পারলে আরো ভালো হয়। তবে সে ক্ষেত্রে কার্পেটাকে প্রতিনিয়ত পরিষ্কার রাখতে হবে, যাতে কার্পেটের ধুলোবালি বাচ্চার সর্দি-কাশির কারণ না হয়।

৬. ছোট বাচ্চাদের গরম ভাব বড়দের তুলনায় বেশি। দেখা যায় তারা গায়ে লেপ, কম্বল কিছুই রাখে না, বারবার ফেলে দেয়। আবার ঘেমে তাদের মাথা ভিজে যায়, বালিশ ভিজে যায়। এভাবেও তাদের ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে এসব বাচ্চাদের ফুল স্লিভ রম্পার জাতীয় জামা পরিয়ে দিলে ঠান্ডার হাত থেকে কিছুটা রক্ষা পাওয়া যায়। ফানেল কাপড়ের স্লিপিং স্যুট গুলোও বেশ কাজে দেয়।

৭. আবহাওয়া শুষ্ক থাকার কারণে বাচ্চাদের গাল, ঠোঁট ইত্যাদি ফেটে যায়। চামড়ার রুক্ষ হয়ে যায়। তখন ভ্যাসলিন এবং মশ্চারাইজার ধরনের লোশন ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যাবে। খেয়াল রাখবেন, ত্বকের স্পর্শকাতরতার জন্য বাচ্চাদের আর বড়দের এসব টয়লেট্রিজ আইটেমে ভিন্নতা থাকে। তাই তাদের জন্য আলাদা করে কিনুন।

৮. শীতের দিনে সবাই চা, কফি খেতে বেশ পছন্দ করে। বড়দের চা-কফির সময়ে বাচ্চাদের দুধ, হরলিক্স, ওভালটিন (যে যেটা পছন্দ করে) জাতীয় গরম পানীয় খেতে দিলে তাদের জন্য ভালো হবে।

৯. শীতে অনেক বাচ্চাদের-ই সর্দি, হাঁচি, কাশি শুরু হয়ে চলতে থাকে। এক্ষেত্রে গরম পানি, রং চা খাওয়া, গরম ভাপ নেয়া বেশ উপকারী। যেসব বাচ্চাদের ঠান্ডাজনিত এলার্জি সমস্যা আছে তাদের নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত।

১০. শীতের দিনে বাচ্চাদের গোসল করতে চায়না। সে ক্ষেত্রে গোসলের আগে তাদের যদি রোদে নিয়ে কিছুক্ষণ রাখা যায় এবং তারা খেলাধুলা করে তবে বাসায় ফিরে হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করে ফেলবে। গোসলের আগে সরিষার তেল, অলিভ অয়েল ইত্যাদি শরীরে মাখলে তাদের আরাম লাগবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সুস্বাস্থ্যের অন্যতম নিয়ামক।

১১. ঠান্ডা, জ্বর, কাশি ইত্যাদি সমস্যা থাকলে বাসায় দুই দিন দেখার পর জ্বরের মাত্রা যদি না কমে ডাক্তারের কাছে অবশ্যই নিয়ে যাওয়া উচিত।বিশেষ করে একদম ছোট বাচ্চা যারা কথা বলতে পারে না তাদের ক্ষেত্রে খুব বেশি সতর্ক থাকা উচিত।

১২. সর্দি-আক্রান্ত ছোট শিশুরা নিজেরা নাক পরিষ্কার করতে পারেনা।সে ক্ষেত্রে নাক পরিষ্কার এর জন্য সাকার (Sucker) ব্যবহার করা যেতে পারে। সাকার দিয়ে নাক পরিষ্কার করা হলে পীড়িত বাচ্চা আরাম বোধ করে।

১৩. শীতের সময় একদম ছোট শিশুদের ডায়াপার পরিয়ে রাখলে বাচ্চা ও মা দুজনেই আরাম পায় । বারবার জামা কাপড়, কাথা নষ্ট হবে না । বাচ্চারও ঠান্ডা লাগবে না। তবে নির্দিষ্ট বিরতিতে ডায়াপার বদলে দেয়ার ব্যাপারে সচেতন থাকা জরুরী।

১৪. শীতের সকালের রোদ বেশ নরম ও মিষ্টি হয়।এ সময় মা ও শিশু সবারই শরীরের রোধ লাগানো উচিত। এই রোদে আছে ভিটামিন ডি, যা আমাদের হাড় মজবুত হতে সাহায্য করে। বর্তমান জীবনযাত্রার ধরণের কারণে ভিটামিন ডি’র অভাব বর্তমানে বৈশ্বিক মহামরির পর্যায়ে চলে গেছে। আমাদের শরীরে নানাবিধ সমস্যার সাথে এই ভিটামিনের অভাবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগ আছে এবং সাধারণত খাবার দিয়ে এর চাহিদা পূরণ হয়না। তাই আমাদের সবারই উচিত দিনে ৩০ মিনিট রোদে থাকা।

১৫. আমাদের দেশের বাসা গুলো শীতকালের জন্য উপযোগী না। দরজা-জানালার ফাঁক, ভেন্টিলেটর দিয়ে বাতাস ঢুকে। অনেক ক্ষেত্রে গাছের জন্য বেশ কিছু বাসায় রোদ পড়ে না। এছাড়া উত্তর দিকের বাসাগুলোতে বেশ ঠান্ডা হয়। এসব বাসায় যদি নবজাতক থাকে এবং ছোট বাচ্চা থাকে তবে তারা ঠাণ্ডায় বেশ কষ্ট পায়।সে ক্ষেত্রে যদি রুম হিটার ব্যবহার করা যায় তবে বাচ্চাদের জন্য বেশ উপকার হবে, ঠান্ডায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা কমে যাবে।

১৬. শীতের সময় ভিটামিন-সি জাতীয় ফল যেমন লেবু কমলা মাল্টা আমলকি ইত্যাদি খাবারগুলো বাচ্চাদের বেশি বেশি করে খাওয়ানো যায়। ঠাণ্ডা সমস্যার জন্য ভিটামিন-সি জাতীয় ফল বেশ উপকারী। যেসব বাচ্চারা চিবিয়ে খেতে পারে না তাদের ফলগুলোর রস খাওয়ানো যেতে পারে।

মায়ের যত্ন

১. শীতকালে স্তন্যদানকারী মায়েদের বেশ সতর্ক থাকা উচিত। তারা এমনভাবে কাজ করবেন যাতে তাদের ঠান্ডা লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা না থাকে।

২. থালাবাসন ধোয়া ধুয়ি কাজ করার সময় তারা যদি হাতে গ্লাভস পরে কাজ করতে পারেন তবে উপকার পাবেন। জামা কাপড় ধোয়ার জন্য ওয়াশিং মেশিন ব্যবহার করতে পারেন। যদি এভাবে সম্ভব না হয় তবে ধোয়াধুয়ির জন্য তারা সাহায্যকারী নিয়োগ করতে পারেন। অথবা দিনের উষ্ণ সময়ে ধোয়ার কাজ সেরে ফেলতে পারেন।

৩. পানি পানের ক্ষেত্রে হালকা গরম পানি পান করুন। স্তন্যদায়ী মায়েদের পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা উচিত। ঠান্ডার কারণে পানি পানের প্রবণতা অনেকেরই কমে যায়। তাই ফ্লাক্সে গরম পানি রাখলে সেটা মিশিয়ে সহজেই কুসুম গরম পানি বারবার খাওয়া যায়।

৪. সকালে ঘুম থেকে উঠে আদা মধু গরম পানি একসাথে মিশিয়ে খেলে তাদের জন্য বেশ উপকারী হবে।আর যদি হালকা ঠান্ডা লেগে যায়, সেক্ষেত্রে আদা- রং চা, মশলা চা বেশ ভালো কাজে দেয়।

৫. আদা মধুর পাশাপাশি এলাচ, দারচিনিও উপকারী। পুরো শীতকাল জুড়ে, বিশেষ করে ঠান্ডা লাগলে কালিজিরা অবশ্যই খাওয়া উচিত৷ সেটা হতে পারে খাবারের সাথে মিশিয়ে যেমন ডাল রান্নার সময় কিছু কালিজিরা দিয়ে দেওয়া৷

৬. পরিষ্কার পরিছন্নতা মায়েদের জন্য খুব জরুরী। মায়েদের গোসলের সময় কুসুম গরম পানি ব্যবহার করে গোসল করা উচিত। এতে তাদের ঠান্ডা লেগে যাবার আশঙ্কা কমে যায়। গোসলের পর যদি তারা রোদে যেতে পারেন, তবে এটি তাদের শরীরের জন্য বেশ উপকারী।

৭. সদ্য প্রসূতি মা সহ ছোট বাচ্চাদের মায়েদের পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম দরকার হয়। সে ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা একান্তভাবে কাম্য। মা যদি সুস্থ থাকেন, তবে পুরো পরিবার সুস্থতা ও শান্তি বিরাজ করবে।

শীতে মা ও শিশু দুজনের শরীরে বেশ নাজুক অবস্থায় থাকে। তাই আগে থেকে যদি সতর্ক থাকা যায় তবে রোগে আক্রান্ত হবার আশংকা অনেকখানি কমে যায়। ঠান্ডা জ্বর সর্দি-কাশি যদি অনেকদিন ধরে হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।

লেখাটি রিভিউ করেছেন –

ডাঃ সাবেরিনা সালাম সারাহ
MBBS, PGT (Pediatrics)
Medical Officer, Pediatrics & Neonatology Department, Bangladesh Specialized Hospital

অনলাইনে পরামর্শ নিন

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা