fruits for nutrition during menopause

মেনোপজ কি?

মেনোপজ মানে হল ঋতুস্রাব বা মাসিক একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়া। বাংলায় এর একটি গালভরা নাম আছে- রজোনিবৃত্তি; কেউ কেউ আবার রজোবন্ধও বলে। এটি মূলত একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। 

নারীদের শরীরে এই পরিবর্তন আসার পেছনে মূল কারণ  ইস্ট্রোজেন হরমোনের অভাব। নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য চক্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হরমোন হল ইস্ট্রোজেন। নারীর ওভারি বা ডিম্বাশয়ে প্রতিমাসে যে ডিম্ব উৎপাদন হয় এবং সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য নারীর শরীর যেভাবে প্রস্তুত হয় তার পেছনেও রয়েছে এই হরমোনের ভূমিকা। 

কিন্তু বয়স হতে থাকলে নারীদের ডিম্বাশয়ে ডিম্বের পরিমাণ কমতে থাকে ফলে শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের উৎপাদনও কমে যেতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় এক সময় পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণত ৪০ থেকে ৫৫ বছর বয়সী মহিলাদের মেনোপজ হয়। তবে বিভিন্ন কারণে তা আরও আগে বা পরে হতে পারে, যেমন- ক্ষীণদেহী ও অপুষ্টির শিকার মহিলাদের আগে হয়। অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে সার্জারি করে জরায়ু বা ডিম্বাশয় কেটে ফেলা, কেমোথেরাপি ইত্যাদি। 

মেনোপজের আগে অনেক সময় শুরু হয় পেরিমেনোপজ। এ সময়ে মাসিক অনিয়মিত হতে শুরু করে।  তা কখনও এক মাস আবার কখনও কয়েক বছর স্থায়ী হয়। মেনোপজ বুঝবেন তখন, যখন দীর্ঘ এক বছর ধরে আপনার মাসিক হবে না। আর মেনোপজ হওয়ার এক বছর পরে হবে পোস্টমেনোপজ ।

মেনোপজের লক্ষণ

মেনোপজের ফলে শরীরে নানা রকম লক্ষণ দেখা যায়। একেক জনের ক্ষেত্রে লক্ষণ একেক রকম হয়। যখন  মেনোপজ হঠাৎ করে শুরু হয়ে যায় তখন এই লক্ষণগুলো আরও বেশি করে প্রকট হয়। 

পেরিমেনোপজ ও পোস্টমেনোপজের লক্ষণগুলোও মোটামুটি একই রকমের। যেমন-এক ধরনের গরম আভা বা উষ্ণতা অনুভব করা, যা হট ফ্লাশ (hot flushes) নামে পরিচিত। এর সাথে কাঁপুনি, রাতের বেলা অতিরিক্ত ঘাম(night sweat), ত্বক লালচে হওয়া প্রভৃতি লক্ষণ থাকতে পারে। এ সময় কারো কারো যোনিপথের শুষ্কতা (vaginal dryness), অনিদ্রা, পেশীর শক্তি কমে যাওয়া, গাঁটে ব্যাথা, প্রস্রাব আটকে রাখার অক্ষমতা, ত্বকের শুষ্কতা, ওজন বৃদ্ধি, জয়েন্টে ব্যথা, মাথা ব্যথা, বুক ধড়ফড় ইত্যাদি সমস্যাও দেখা দেয়।মানসিক সমস্যার মধ্যে রয়েছে অবসাদ , অস্থিরতা , হঠাৎ করে মুডের পরিবর্তন, মনোযোগ কমে যাওয়া, স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।

symptoms of menopause মেনোপজের লক্ষণ

মেনোপজে করণীয়

মেনোপজের পর থেকে শরীরে কিছু পরিবর্তন হয়। আবার বয়সের কারণেও নানা রোগ বাসা বাঁধে। মেনোপজকে সে ক্ষেত্রে অ্যালার্ম হিসেবে ধরা হয়। মানে এটি আপনাকে মনে করিয়ে দেবে, এবার সাবধান হতে হবে! কি কি বিষয় নিয়ে এখন থেকে মাথা ঘামাতে হবে তা দেখে নিন-

১. হাড় ও মাংসপেশি

মেনোপজ সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে নারীর হাড়ে। শরীরে হরমোনের অভাবে হাড়ের ক্যালসিয়াম কমতে শুরু করে। সতর্ক না হলে ও যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে এক সময়  হাড়ের ক্ষয় (Osteoporosis) শুরু হয়। বিশেষ করে কোমর এবং কোমরের নিচের দিকের হাড় খুবই দুর্বল হয়ে যায়। তাই বেশিরভাগ নারীই কোমরের ব্যথায় ভুগে থাকেন। 

ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি এক্ষেত্রে মূল চিকিৎসা। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান হলো ভিটামিন কে, যা এ দুটোর পরিপূরক। ডাক্তার আপনাকে এগুলোরই সাপ্লিমেন্ট দিবে, কারণ সাধারণত মানুষ দৈনন্দিন খাবারের মাধ্যমে এগুলোর চাহিদা পূরণ করতে পারে না। কিন্তু আপনি যদি নিয়ম করে এবং পরিমানমত পুষ্টিকর খাবার খেতে পারেন, তাহলে এ নিয়ে বেশি চিন্তার কিছু নেই। প্রতিদিন অন্তত দুই সারভিং( ৫০০ মিলি)  দুধ বা দুধ জাতীয় খাবার, একটি ডিম, ২-৩টি খেজুর, এক মুঠ বাদাম ইত্যাদি খেলে এই দুইয়ের চাহিদা অনেকটাই মিটবে। সাথে অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার তো খাবেনই। আর হ্যা, ভিটামিন ডি সক্রিয় করতে প্রতিদিন গায়ে একটু রোদ লাগানোও জরুরি, প্রতিদিন বেলা ১০টা থেকে ৩টার মধ্যে অন্তত ১০ মিনিট।

আর একটি গুরুত্বপূর্ণ  কথা হলো , কায়িক শ্রমহীন জীবনযাপন অস্টিয়োপোরোসিস বাড়ায়। একটানা বেশিক্ষণ বসে থাকায় অভ্যস্ত হলে হাড় ক্যালসিয়াম খোয়াতে থাকবে। এছাড়া স্টেরয়েড জাতীয় ও থাইরয়েডের ওষুধও অস্টিওপোরসিসের সম্ভাবনা বাড়ায়। তাই এ সময়ে ক্যালসিয়াম আর ভিটামিন ডি এর সাথে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা ও কিছু এক্সারসাইজও জরুরি।

আপনার শরীরের মাংসপেশিও এ সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতি বছর ১% করে মাংসপেশি কমতে থাকে, যা টের পাওয়া যায় না শরীরে চর্বি বৃদ্ধির কারণে। এর জন্য চাই পরিমিত প্রোটিন। কম চর্বি সমৃদ্ধ মাংস যেমন চিকেন, মাছ, ডাল, বাদাম, বীজ ইত্যাদি খাবার প্রতিদিন পরিমাণমত খেলে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।

২. স্থুলতা

স্থুলতা হল এমন একটি রোগ, যা অন্যান্য সব রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর বয়সীদের নিয়ে একটি লেখায় বলা হয়েছিল কিভাবে বয়সের সাথে সাথে মেটাবলিজম কমার ফলে ওজন বাড়তে থাকে । চল্লিশের পর আবার নতুন সমস্যা যুক্ত হয়, ক্ষুধাও বেড়ে যায়! ইস্ট্রোজেন কমার ফলে আপনার শরীরের ইনসুলিন আর থাইরয়েড হরমোনের লেভেলও কমে যাবে। এই তিনে মিলেই ক্ষুধাভাব জাগিয়ে তোলে। 

তাই খুব বুঝে খেতে হবে আপনাকে। ধীরে ধীরে খাবার খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে ফেলতে হবে। পেট বেশিক্ষণ ভরা রাখার জন্য ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে, যেমন- শাক সবজি, ফলমূল, বাদাম ইত্যাদি। চিনি, ফ্যাট, বিশেষ করে রেড মিট, হাই-ফ্যাট ডেইরি ইত্যাদি খাওয়া বাদ দিতে হবে। সাথে প্রতিদিন এক্সারসাইজ করুন। এতে আপনার বাড়তি ওজন অনেকটাই নিয়ন্ত্রের মধ্যে থাকবে। একই সাথে আপনার এনার্জি বাড়বে, রাতে ঘুম ভালো হবে, হঠাৎ করে মুডের যে পরিবর্তন হচ্ছিল সেটাও হবে না। ফুরফুরে ও সতেজ থাকবেন।

৩. ডায়বেটিস ও হৃদরোগ

এ দুটোই এ সময়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ আর আপনার খাদ্যাভ্যাস এর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। ডায়বেটিস না হলেও এ সময়ে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা খুব মেপে খাওয়া উচিত বা খেলেও কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট খাওয়া উচিত, যেমন- লাল চালের ভাত, লাল আটার রুটি, ওটস, সবজি, শিম ইত্যাদি। সিম্পল কার্বোহাইড্রেট এর উৎস- চিনি তো বটেই, মিষ্টি জাতীয় ফল, সাদা ভাত, আলু ইত্যাদি খাওয়াও একেবারে কমিয়ে ফেলতে হবে। 

হার্টের দেখভাল করতে হলে ফাইবার জাতীয় খাবার বেশি খাওয়ার পাশাপাশি কমিয়ে ফেলতে হবে তেল ও লবণের ব্যবহার। সম্ভব হলে অলিভ অয়েল ব্যবহার করুন রান্নায়। ফলমূল, মিষ্টি আলু, শাক এগুলো পটাসিয়াম সমৃদ্ধ বলে আপনার বাড়তি থাকা প্রেশারকে লাগাম দিবে। হার্টকে ভালো রাখতে আরেকটি খাবার খুব কার্যকরী, আর তা হল- ফাইটোইস্ট্রোজেন। এটি উদ্ভিদ এ বিদ্যমান একটি উপাদান, যা প্রাণীদেহে ইস্ট্রোজেনের মতো কাজ করে, হার্টকে ভালো রাখে। সয়াবিন ও এ জাতীয় খাবার, ওটস, তিল ও বিভিন্ন বীজ, মুগ ডাল, আপেল, গাজর, কিশমিশ, খেজুর ইত্যাদি ফাইটোইস্ট্রোজেন এ ভরপুর খাবার। 

ডিমের কুসুম নিয়ে আমাদের দেশে অনেকের ভয় থাকে, বর্তমান গবেষণা বলে নির্ভয়ে খেতে পারেন। আপনার জন্য আরো একটি সুখবর হল- আদা, রসুন আর হলুদ, যা আপনি প্রতিদিনের রান্নায় ব্যবহার করেন, তা শরীরে প্রদাহ কমিয়ে দেয়, ফলে হৃদরোগের ঝুঁকিও যায় কমে। 

তবু এ বয়সে সচেতন হওয়া জরুরি, বিশেষ করে পরিবারে কারো হৃদরোগের ইতিহাস থেকে থাকলে। আরেকটি জিনিস খুব জরুরি তা হলো- এক্সারসাইজ। এই একটি জিনিসের কথা বারবার বলা হয়, কিন্তু এর অভাব থেকেই যায়। হুট করে ভারি এক্সারসাইজ শুরু করার দরকার নেই, একটু একটু করে প্রতিদিন করবেন। সারাদিনে ১০ মিনিট ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ কিংবা ২০ মিনিট জোরে হাঁটা কঠিন কিছু না, বাসার ভেতরেই সম্ভব। শুধু চাই একটু চেষ্টা, আর কিছু না।

৪. বার্ধক্য

বার্ধক্য জনিত সমস্যা শুরু হওয়ার জন্য বৃদ্ধ হওয়া জরুরি না। আজকালকার জীবনযাত্রার ধরনের কারণে মধ্যবয়স থেকেই মানুষ নানা সমস্যায় জর্জরিত। অথচ একটু নিয়ম মেনে চললেই এসব থেকে বেঁচে থাকা যায়। 

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার বার্ধক্য জনিত সমস্যা প্রতিহত করে। আমাদের পরিচিত- ভিটামিন ই আর ভিটামিন সি শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। এরা মূলত শরীরে তৈরি হওয়া ফ্রি রেডিকেলের বিরুদ্ধে কাজ করে। এক্ষেত্রে আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপাদান হল- সেলেনিয়াম, ক্যারটিনইডস, ম্যাগনেশিয়াম, জিঙ্ক ইত্যাদি। সব গুলোর আলাদা আলাদা উৎস মনে রাখতে হবে না, প্রচুর শাক সবজি, ফল, সালাদ, ডিম, চর্বি ছাড়া মাংস ইত্যাদি খেলেই এসব নিশ্চিত হবে। 

বার্ধক্য জনিত সমস্যা বিলম্বিত করতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হল ফাস্টিং বা রোজা। বর্তমানে এটি নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। ক্যানসার, আলঝেইমার, পার্কিনসন, ডায়বেটিস, হার্টের অসুখ সহ বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে এটি এখন একটি নিরাময় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই পরিমিত আহারের সাথে মাঝে মধ্যে ফাস্টিং করুন।

৫. স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট

স্ট্রেস হল স্থূলতার মতোই একটি সাইলেন্ট কিলার, যা অন্যান্য রোগ-অসুখ বাড়িয়ে দেয়। সামাজিক কারণ ছাড়াও, হরমোনাল কারণেও স্ট্রেস বেশি বোধ হয় এই বয়সে। এসব স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট কি করে করবেন, তা আপনাকেই ভেবে বের করতে হবে, কারণ একেক জনের ক্ষেত্রে তা একেক রকম। কিছু পরামর্শ অবশ্য দিতে পারি-

  • আগে খুঁজে বের করুন কোন কাজ গুলো বেশি স্ট্রেস দিচ্ছে আপনাকে। ধীরে ধীরে সেগুলো বাদ দিয়ে দিন অথবা কারো সাহায্য নিন। এতে আপনার ভার কমবে। 
  • আপনার শখের কাজটি স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করবে, সেটা বাগান করা, ছবি আঁকা কিংবা রান্না- যেটাই হোক না কেন।
  • সব সময় পজিটিভ চিন্তা করুন, অতীত নিয়ে আক্ষেপ বন্ধ করুন। এতে মানসিক চাপ কমে আসবে।
  • খাবারের ভেতর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে। 
  • ছিমছাম, পরিষ্কার, আলো বাতাসে পরিপূর্ণ একটি ঘর স্ট্রেস কমাতে একটি বড় নিয়ামক। অগোছালো ঘর কে পছন্দ করে? 
  • আপনজনদের খোঁজ খবর নিন প্রায়শই। সবার সাথে সুসম্পর্ক রাখুন। সন্তানদের জাপটে ধরে আদর করুন। অনেক কাজে দিবে। 
  • বেশি বেশি ধর্মীয় গ্রন্থ পড়ুন, প্রার্থনা করুন। বিদেশে মেডিটেশন করতে বলে, মুসলিমদের জন্য নামাজ অপেক্ষা উত্তম মেডিটেশন কি হতে পারে?
  • বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে অংশ নিন, ভালো লাগবে। বিশ্বাস করুন, অপরের উপকার করে যে তৃপ্তি পাওয়া যায়, তা অমূল্য!

মনে রাখবেন, মেনোপজ কোনও সমস্যা নয়। তবে অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন এ সময়ে সমস্যা বয়ে আনতে পারে। পুষ্টিকর খাবার খেলে আর  জীবনে কিছু পরিবর্তন আনলেই সেগুলো এড়ানো যায়। তাই প্রাজ্ঞের এ বয়সে অযথা দুশ্চিন্তা না করে ভালো চিন্তা করুন আর সবার মাঝে ভালোবাসা ছড়িয়ে দিন! 

ছবিঃ Familydoc, nature

লেখাটি রিভিউ করেছেন –

ডাঃ সাবরিনা আফরোজ
MBBS, MPH
লেকচারার, ঢাকা কমিউনিটি মেডিসিন কলেজ

সম্পাদনায়ঃ হাবিবা মুবাশ্বেরা