আমার ছেলে হবে জানার সাথে সাথেই ঠিক করে রাখছিলাম হওয়ার পরপরই মুসলমানি করিয়ে ফেলব। অনেক মায়েদের এক্সপিরিয়েন্স আর পড়াশুনা করে জেনেছিলাম যে যত আগে করানো যায়, তত ভালো। বাচ্চাদের যেহেতু পেইন সেনসেশন কম থাকে, এজন্য বাচ্চা এবং মা দুইজনেরই কষ্ট কম হয়। তাই খুব চেয়েছিলাম জন্মের পরপরই খৎনা করিয়ে দিতে।
গেলামও ডাক্তারের কাছে।অনেকগুলা টেস্ট দিল। করলাম। দেখে বলল সব ঠিক আছে। কিন্তু উনি এত ছোট বাচ্চার খৎনা করবেন না। আরেকজন ডাক্তারের কাছে রেফার করে দিলেন। উনিও একই কথা বলে আরেকজন ডাক্তারের কাছে রেফার করে দিলেন। এরপরে যার কাছে রেফার করেছেন, তার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে শুনি উনি এই অপারেশনের জন্য ৩০ হাজার টাকার বেশি নেন। এটা আমার সামর্থ্যের বাইরে এবং অতিরিক্ত মনে হইছে।
এরপরে আরও ৩/৪ জনের ব্যাপারে খোজ নেই। কেউই করতে আগ্রহী নন। যেহেতু এত ছোট বয়সে মুসলমানি করানো বাংলাদেশের কালচারে নাই। বেশি সমস্যা থাকলে করাবেন। কিন্তু সমস্যা না হলে মিনিমাম এক বছরের আগে করাবেন না। অনেকে আরও পরে করবেন। লেজার, ডিভাইস খতনা, নরমালি যেভাবে করানো হয়- এরকম সব ডাক্তারের সাথে কথা বলে বলে বিরক্ত হয়ে আমি মুসলমানি করানোর চিন্তাই বাদ দিলাম।
একেতো করবে না, যারাও করে তাদের খরচ অনেক বেশি। তাই এক বছর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করব ডিসিশন নিলাম। এক বছর হওয়ার সাথে সাথেই খৎনা করিয়ে দিলাম। নরমালি যেভাবে কেটে করা হয়, ওইভাবেই করাইছি।আলহামদুলিল্লাহ ভালোভাবে করানো হয়েছে।
সার্জিরিতে নিয়ে যাওয়ার আগে বাচ্চাকে ভালোভাবে সলিড খাইয়ে নিয়েছি। আগেই একটা নাপা সাপোসিটরি দিয়েছি যাতে পেইন কম হয়। আমার ছেলে অনেক আহলাদি। এমনিতেই অনেক কান্নাকাটি করে। আর এই সার্জারিতে আরও বেশি কান্না করবে এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। হলোও তাই। সার্জারির পর টানা দুই ঘন্টা শুধু কান্না করছে। পরে ঘুমানোর জন্য ঔষধ দিলাম। ঘুমাইলো ঠিকই কিন্তু আমাদেরকে হাত পা ধরে বসে থাকা লাগলো যাতে ক্ষতস্থানে হাত না দেয়।
সার্জারির পর ডাক্তার ঔষধ লিখে দেওয়া ছাড়া কিভাবে ম্যানেজ করব এই ব্যাপারে কোনকিছুই বলে দেন নাই। ছোট বাচ্চাকে কি এত ধরে রাখা যায়? তখন আমার মাথায় আসল ডায়াপার পরানোর কথা। আশেপাশের সবাই বলতেছিল খোলা রাখতে, তাহলে নাকি তাড়াতাড়ি শুকাবে। কিন্তু আমার মনে পড়লো, দেশের বাইরে সার্জারির পরপরই ডায়াপার পড়িয়ে দেয়।
আশেপাশের মানুষদের আরেকটা পরামর্শ ছিল শীতের সময় সার্জারিতে সেলাই শুকাইতে টাইম লাগে। কিন্তু আমি জেনেছিলাম ঠান্ডার দেশের বাচ্চাদেরও এইখানের মত ৭ দিনেই সেলাই শুকাইয়া যায়। খৎনা করানো নিয়ে কয়েকজন মায়ের লিখা থেকে দেখলাম, ওনারা বাংলাদেশেই খৎনার পরপর ডায়াপার পরিয়েছেন। আমিও তাই সাহস করে পরালাম। এবং অবাক করার মতো বিষয়ঃ আমার ছেলে আর কান্নাকাটি করছে না। যেটা বুঝলাম যেহেতু ক্ষতস্থানে ওর হাত লাগছে না বা পা নাড়ালেও অপারেশনের জায়গায় কোন ঘসা লাগতেছে না। ও নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুম দিল। ঘুম থেকে উঠে সুন্দর ওর রেগুলার কাজ ( হামাগুড়ি দেওয়া, চেয়ার টানাটানি করা, খেলা) সব হাসিখুশি ভাবে করতে লাগল, আলহামদুলিল্লাহ।
মোটামুটি ওর প্রতিক্রিয়া দেখে আমরা অবাক এবং বেশ খুশি। ওকে কোলে নেওয়াও অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিলো, যা কিনা ডায়াপার পরানোর আগে খুবই সমস্যা মনে হচ্ছিলো। ও খাট থেকে নামতে পারে। ওঠানামার সময় যাতে ক্ষতস্থানে ঘষা না লাগে শুধু এইটা খেয়াল রেখেছি।
যেটা বুঝেছি, বাচ্চা ব্যাথার চেয়েও ভয়ের কারণে কান্না করছিল বেশি। সুন্নত করানোর সময় ওর হাত-পা ধরে রাখা হয়েছিল। এছাড়া ডায়াপার পরানোর আগে যতবারই ক্ষতস্থানে যাতে হাত না লাগায় এজন্য হাত-পা ধরে রাখছিলাম। এসব কিছুই তাকে অপারেশনের সময়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। এবং একই ব্যাপার হচ্ছিল যতবার ওর নিজের হাত ওই জায়গায় লাগতেছিল। এখন বরং আফসোস লাগছে কেন সার্জারির পরপরই ডায়াপার পড়ালাম না সেটা ভেবে। যতটুকু কষ্ট পেয়েছে, সেটাও সম্ভবত হতো না।
আলহামদুলিল্লাহ তিন দিনের মধ্যে সেলাইয়ের জায়গা শুকিয়ে গিয়েছিল। আর ব্যান্ডেজ চারদিনের দিন এমনিতেই খুলে আসছে। বাকিটা কুসুম গরম পানিতে বসিয়ে হাল্কা টান দিতেই চলে আসছে। অক্টোবর মাসের শেষে খৎনা করানো হয়েছে, এসময় হালকা ঠান্ডা ছিল। আর সেলাই পুরাপুরি মিলিয়ে যেতে দশ দিনের মতো লেগেছে। এই পুরা সময় আলহামদুলিল্লাহ ওর খাওয়া দাওয়া, খেলাধুলা, পটি সব নরমাল ছিল। ওর মুসলমানি করা হয়েছে, এটা সে ভুলে গেলেও আমরা সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলাম।
ছোট বাচ্চাদের ব্যাথার অনুভূতি কম থাকে। তাই বাচ্চা শোয়া অবস্থায় থাকাকালে খৎনা করানোর ভাল সময় হলো। যদিও বাংলাদেশে ওই ছোট বয়সে মুসলমানি করানোর চর্চা নেই, এইটাই আফসোস। তাও আলহামদুলিল্লাহ সবকিছু ঠিকমতোই শেষ হয়েছে।
খরচ
আমি প্রথমে ঢাকার ভালো হাসপাতাল গুলাতে খোজ নিয়েছি। হাসপাতালভেদে ১০-৪৫ হাজার টাকা লাগবে বরে জেনেছিলাম। পরে আমার বাসার কাছের ডক্টর চেম্বার থেকে সার্জারি করাই।আমার জন্য এটাই সুবিধাজনক ছিল। আর মেডিসিনসহ আমার মোট ৩ হাজার টাকা খরচ পড়েছে।
টিপস
১. যেহেতু মুসলমানি করানোই লাগবে, তাই যত আগে আগে সম্ভব করানোই ভাল। ছোট বাচ্চা, কান্না করবে, ব্যাথা পাবে ইত্যাদি বলে দেরি যত করা হয়, তত বাচ্চাটার জন্য শারীরিক ব্যাথা এবং বুঝে, কথা বলতে পারে এমন বাচ্চার জন্য মেন্টাল ট্রমার কারন করে ফেলি আমরা এই ছোট্ট অপারেশনকে। অবশ্য বাচ্চার যদি অন্য কোন শারীরিক সমস্যা থাকে তাহলে আলাদা ব্যাপার।
২. ডায়াপার পরানোর ক্ষেত্রে বেল্ট সিস্টেম পরানোটা সহজ এই সময়ে।আর অবশ্যই বাচ্চার সাইজের ডায়াপার পরানো।তাহলে ক্ষতস্থানে ঘষা খাওয়ার চান্স কম থাকে।
৩. প্রত্যেকবার ডায়াপার পরানোর সময় একটা wet wipes নিয়ে সেটাকে চারকোনা করে ভাজ করতে হবে & পুরু করে wipes এ vaseline লাগিয়ে নিতে হবে।এরপরে এই ভাজ করা Wipes টাকে অপারেশনের জায়গাটার উপর রেখে একটু ঢিলা করে ডায়াপার পরাতে হবে। এভাবে পরালে অপারেশনের জায়গাতে ডায়াপারের সাথে ঘষা লাগে না।বাচ্চা হিসু করলেও আর ব্যাথা পায় না।
৪. যখন বাচ্চা ঘুমে থাকে, তখন সম্ভব হলে কিছু সময় খুলে বাতাসে রাখা জায়গাটা। না রাখলেও সমস্যা হয় না।ক্রিম লাগালে আর ঔষধ ঠিকমত খাওয়ালে এমনিতেই সেলাই ভাল হয়ে যায় ।
৫. পটি করলে ডায়াপার চেঞ্জ করার সময় সেলাইর জায়গা বাদ দিয়ে বাকি জায়গা ভালোভাবে wipes দিয়ে পরিষ্কার করে দেওয়া।
৬. আর রেগুলার টাইমের চেয়ে একটু কম গ্যাপে ডায়াপার চেঞ্জ করা, অর্থ্যাৎ ঘনঘন ডায়াপার বদলানো
৭. আমার ছেলের মাইক্রোপোর রিএকশন হইছিল। এটা অনেকেরই নাকি হয়। র্যাশ উঠে গেছিল।ডাক্তারকে বলার পর একটা ক্রিম দিছে। যদিও আমি লাগাই নাই। শুধু ভ্যাসলিন দিয়েছি, এমনিতে চলে গেছে।
৮. ডায়াপার চেঞ্জের সময় wet wipes টা তুলে ক্রিম লাগানো এবং নতুন wipees রাখার টাইমে বাচ্চা একটু ব্যাথা পাবেই। এইটা নরমাল।ডায়াপার পরা হয়ে গেলে আবার আগের মত খেলতে থাকে।
আমি যা জেনেছি আর অভিজ্ঞতা দুই মিলে সব শেয়ার করলাম। কারন নতুন মা হওয়াতে আমার নিজের অনেক প্রশ্ন ছিল।অনেক টেনশনও হচ্ছিল। আশা করছি আমার এই লিখা থেকে হয়ত অন্য কেউ কিছুটা হলেও উপকৃত হবে
সম্পাদনাঃ নেজাম উদ্দীন