
বহুদিন এই সমস্যাটা ছিল না। লম্বা সময় ধরে গাড়িতে বসে থাকলেও আমার খুব বেশি অসুবিধা হতোনা। যদিও ছোটবেলা থেকে গাড়ীতে বসে থাকা আমার জন্য ভীষণ কষ্টকর ছিল। বমিটা করেই প্রথমে মনে হচ্ছিল, গাড়িতে চলার জন্যই হয়েছে। বাসায় দূর থেকে আসা মেহমান ছিল, তাই খুব বেশি পাত্তা না দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলাম কিন্তু শরীর একটু একটু খারাপ লাগছিল।
জুন মাসের কথা বলছিলাম ততদিনে আমার প্রেগনেন্সি ০৩ মাস পার হয়ে গিয়েছে। পিরিয়ড অনিয়মিত সবসময়, তাই বুঝতে পারছিলাম না। পরের দুই মাস ছিল বেশ ভয়াবহ- স্বেচ্ছায় হসপিটালে ভর্তি হতে চেয়েছিলাম। বমি করতে করতে বাথরুমে পড়ে যেতাম। কিছু সময় ওখানেই কখনো কখনো অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতাম। কখনো নিজেই জেগে উঠতাম আবার কখনো কেউ এসে দেখে নিয়ে যেত। ঐ সময়ে মানসিক ও শারীরিক অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল আমি সেমিস্টারের প্রায় শেষে এসে সেমিস্টার ড্রপ করেছিলাম। সময় যেতে তো শুধু সময় লাগে, সেই সময়টা তাই পার হয়ে গেল। বাকি সময়টাতে মাস্টার্সটা শেষ করলাম। ডিসেম্বর মাসেই থিসিস জমা দিয়ে ডিফেন্স শেষ করে একদম ঝাড়া হাত-পা। এরপর শুধুই অপেক্ষা।
অপেক্ষা এত দীর্ঘ হবে বুঝতে পারিনি। দীর্ঘ বলছি, কারণ আমি ৪২ সপ্তাহে গিয়ে বাচ্চার দেখা পাই। পর্যাপ্ত হাঁটাহাঁটি ও অন্যান্য ব্যায়াম অব্যাহত রেখেছিলাম। শীতের সময়ে হাঁটাহাঁটি ভীষণ কষ্টকর মনে হতো এখানে। ভারী শরীরটা একগাদা কাপড় চোপড়ে মুড়ানো, সাথে স্নোবুট আর পিছলে পড়ার আশংকায় শেষদিকে বাসায় বা লবিতে হাঁটতাম।
বলে রাখা ভালো, বন্ধুত্বের সুবাদে মাতৃত্ব প্রিনাটাল কোর্সের কোঅর্ডিনেটর আফিফার সাথে আমি প্রি-ন্যাটাল ক্লাস করেছিলাম। বর্তমানে চলমান প্রিনাটাল কোর্সের আনঅফিসিয়াল প্রথম ব্যাচের ছাত্র আমি। প্রথম প্রেগন্যান্সিতে যা জেনেছিলাম তার অনেক কিছুই ভুলে গিয়েছিলাম। তাই ক্লাস করে নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছিলাম।
আমার প্রেগন্যান্সিতে এবং পোস্ট-পার্টামে সবার সহযোগিতা আর প্রি-নাটাল ক্লাস গুলো আমাকে অনেক আত্মপ্রত্যয়ী করেছিল।
প্রেগন্যান্সিতে আমার কোন জটিলতা ছিলনা। থাইরয়েড নিয়ে একটু ঝামেলা ছিল, নিয়মিত ওষুধ খাওয়া লাগতো। তবে হরমোনের লেভেল অনুযায়ী ওষুধের ডোজের পরিবর্তন করতেন ডাক্তার। মাসে অন্তত একবার ব্লাড টেস্ট করা লাগতো। আঠাশ সপ্তাহে গিয়ে আয়রনের ঘাটতি দেখা দেয়। আমার ইতিউতি সত্ত্বেও সাপ্লিমেন্ট লিখে দিলেন ডাক্তার। আমি অবশ্য আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খেয়ে ম্যানেজ করেছিলাম ব্যাপারটা। খুব সাধারণ সময় পার করেছি আর নিয়মিত কাজ করে নিজেকে আ্যকটিভ রাখতাম আর সাথে ছিলো আড়াই পার না হওয়া টডলার।
৩৮ সপ্তাহের পর থেকে ব্লাড প্রেসার নর্মাল ছিলোনা। আমার ব্লাড প্রেসার এমনিতেই কম এবং সেটাই আমার জন্যে স্বাভাবিক। কিন্তু ডাক্তার বললেন আমার এখনকার ব্লাড প্রেসার আগের রেগুলার ব্লাড প্রেসার চেয়ে বেশী। কিন্তু এটাকে বিপদজনক বলবেন কিনা বুঝতে পারছিলেন না। স্ট্রেস নিতে না করলেন। পজিটিভ চিন্তা ভাবনা করার জন্য বললেন।
৪১ সপ্তাহে এসে কিছু টেস্ট করলেন যাতে বাচ্চা এবং আমি ঠিক আছি কিনা বুঝতে পারেন। রিপোর্ট দেখে ৪২ সপ্তাহে ইনডাকশনের তারিখ দিলেন। আমি আরেকটু সময় নিতে চাইছিলাম, কিন্তু আমার হঠাৎ বাড়তি ব্লাড প্রেশারের কারণে ডাক্তার রাজি হলেন না ।
প্রথম থেকেই প্রচুর পরিমাণে খেজুর খেতাম। ইনডাকশনের কথা শুনে খুব দু‘আ করছিলাম আর খেজুর খাওয়া শুরু করলাম আরো বেশি পরিমাণে। হাঁটা শুরু করলাম আরো বেশি। আমার দিক থেকে চেষ্টায় কোন কমতি রাখতে চাইনি। ক্যাসক্যাড অব ইন্টারভেনশনের চিন্তায় একটু অস্থির লাগছিলো আর ভাবছিলাম আমার করণীয়। ইনডাকশনের আগেরদিন ২৪ তলা ঊঠানামা করলাম হাঁটাহাঁটির পাশাপাশি। রাতে হসপিটাল ব্যাগটা চেক করে নিলাম আরেকবার। বড় বাচ্চার ব্যাগ গুছিয়ে রেডী করে রাখলাম আর ঘরের কাজ করছিলাম। সাথে স্কোয়াট করছিলাম একটু পরপর। আমার সারভিক্স পাঁচ সেন্টিমিটারোর মতো খোলা ছিলো। তাই আমার বারবার মনে হচ্ছিলো আর কিছু দিন অপেক্ষা করলে নরমাল ডেলিভারি হবে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু তেমন কোন পেইন ছিলোনা।
পরদিন সকালে বড়জনকে নির্ভরযোগ্য হাতে রেখে চলে গেলাম হসপিটাল। ভর্তির জন্যে সব কাজ নিজে নিজেই করলাম। মিউকাস প্লাগ আর রেগুলার সামান্য ব্যাথা ছাড়া আর কিছুই তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। কভিড টেস্ট শেষে ডাক্তার এসে চেক করে বললো সারভিক্স প্রায় সাত সেন্টিমিটারের মতো ডায়লেক্টেড আর বেবির মাথা ডিপলী ডাউন হয়ে আছে পেলভিকে।কন্ট্রাকশন আরো বাড়াতে পানি ভেঙ্গে দিলেন।
সারভিক্স খুলতে অনেক সময় লাগছিলো আর বাচ্চার কথা চিন্তা করে ডাক্তার আর অপেক্ষা না করে ইনডাকশনের জন্য জোর করতে লাগলেন। তখন দুপুর সাড়ে বারোটার বেশি হবে। ইনডাকশনের ১৫-২০ মিনিট পর থেকে তীব্রতর ব্যাথা অনুভূত হচ্ছিল। পেইন ম্যানেজ করেছিলাম হেঁটে হেঁটে আর প্রচুর দু‘আ করছিলাম। খেজুর খাচ্ছিলাম লুকিয়ে লুকিয়ে। প্রথমবারের মতো দুর্বল হতে চাইনি পুষিং করার সময়, তাই এমন কাজ করা। ব্যাথার তীব্রতা আর ফ্রিকোয়েন্সি বেড়েই যাচ্ছে।
এরপর আর সময় জ্ঞান ছিলো না। আমি বাচ্চার মাথার চাপ অনুভব করলাম পেলভিকে। ডাক্তার এসে চেক করে বললো আমি পুষ করার জন্য তৈরি। আমি দাঁড়িয়ে পুষ করতে চাইলেও ডাক্তার রাজি হলেন না। পেলভিক এরিয়া ন্যারো বলে পুষিং খুব চ্যালেঞ্জিং আমার জন্য। তবে আল্লাহ এইবার অনেক সহজ করেছেন। অনেক পুষ করা লেগেছে কিন্তু গতবারের চেয়ে কম। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে বাচ্চা আমার বুকের উপর। এইবার ও ভ্যাকুয়াম আ্যসিস্ট্যান্স লাগলো প্রায় সাড়ে তিন কেজির বাচ্চাকে বের করে আনতে। ন্যারো পেলভিক দিয়ে বাচ্চা বের হয়ে আসার সময় শুধু আমার পুষিং এ কাজ হয়নি।
প্লাসেন্টা ডেলিভারির সময় ডাক্তার বলছে তুমি অনেক সাহসী। আবার জিজ্ঞেস করল এইবার কতবার পুষ করেছি কাউন্ট করেছি কিনা কারন আমি আগেরবারের ৮১ বারের বেশী পুষিং এর অভিজ্ঞতা তাকে শুরুতেই জানিয়েছিলাম। সেকেন্ড ডিগ্রী টিয়ার সামাল দিয়ে ডাক্তার বিদায় নিলো। বাচ্চার কমতে থাকা ওজন নিয়ে চিন্তিত ডাক্তার আমাকে ২৪ ঘন্টা পর রিলিজ দিলেন। আলহামদুলিল্লাহ।
পরের কয়েকটা দিন একটু কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়।পাশে পেয়েছি অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুদের পরামর্শ, সহানুভূতি আর সহযোগিতা যা মানসিকভাবে আমাকে সেরে উঠতে সাহায্য করেছে। আমার প্রেগন্যান্সিতে এবং পোস্ট-পার্টামে সবার সহযোগিতা আর প্রি-নাটাল ক্লাস গুলো আমাকে অনেক আত্মপ্রত্যয়ী করেছিল। বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা দুই-ই আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন অফুরন্ত যার কৃতজ্ঞতা জীবনভর থাকবে।
You must be logged in to post a comment.