একজন খুবই জনপ্রিয় শায়খের কাছে এক মহিলা পরামর্শ চেয়েছিলেন, তাঁর স্বামীকে পরকীয়া থেকে কীভাবে ফেরাবেন এ ব্যাপারে। শায়খ উত্তর দিলেন, আগে থেকে সেজেগুজে থেকে রাতে স্বামীকে বিছানায় এতই ব্যস্ত রাখতে হবে যাতে দিনের বেলা পরকীয়া করার মত শক্তিই আর বাকি না থাকে।
আরেক ফতোয়ায় তিনি বলেছিলেন, দেওবন্দী পুরুষের সাথে সহীহ আক্বীদাহর নারীর বিবাহ হারাম, দেওবন্দীদের জন্য আহলে কিতাবদের মত হুকুম।
আমার পরিচিত দ্বীনি বোনদের ব্যাতিক্রম কেউ কেউ বাদে প্রায় সবাই ভীষণভাবে এই শায়খের ভক্ত। তাঁর ভক্তদের কথা বাদ দিলাম, শায়খ নিজেও হয়তো জানেন না যে তিনি অন্যের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে না পারার কারণে কত ঠুনকো ও হাস্যকর পরামর্শ দিয়ে বসেন, এটাও জানেন না যে কুরয়ান সুন্নাহ থেকে হুকুম বের করতে যে পরিমাণ বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা তৈরি হওয়া লাগে, সেটা তাঁর নেই।
এই উদাহরণের মত অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়। সত্যি বলতে এই উদাহরণই আসলে আমাদের সমাজের বেশিরভাগ শায়খের ক্ষেত্রে টিপিকাল চিত্র। এমন মাদ্রাসা কারিকুলাম আমাদের দেশে, যেখানে কুরয়ানের টেক্সট আছে, হাদীসের টেক্সট আছে, মস্তিষ্কের ট্রেইনিং তো নেইই, বরং মানুষকে নিজের মত ছেড়ে দেয়া হলে স্বাভাবিক যে বোধবুদ্ধি অক্ষত থাকে, সেটা এই কারিকুলামের চাপে ধ্বংস হয়েছে তিলে তিলে। মানুষ জাহেল হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢোকে, জাহেল মুরাক্কাব হয়ে বের হয়। ইসলামের ও সেক্যুলার অনেক আলেমের মতে, এই মানুষগুলো পড়াশোনা না করলেই বরং ভালো হতো। জানে না যে এটা তো অন্তত জানতো!
আমাদের নিজেদের ক্ষেত্রেও এর ব্যাতিক্রম হয়নি। জেনারেল লাইনেও প্রচলিত সিস্টেমে আমাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন ক্ষমতাকে তিলে তিলে ধ্বংস করা হয়েছে বলে আমরা অনেক কিছুই বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু ভয়ানক ব্যাপার হলো, আমরা এ ব্যাপারটা জানি না। আমরা নিজেদের মতামত ও বুঝের ওপর খুবই আত্মবিশ্বাসের সাথে নির্ভর করি, এক্সপার্ট কারা সেটা বুঝতেও ভুল করি, কেননা এক্সপার্ট চিনতে পারাও একটা এক্সপার্টিজ। এবং ভুল এক্সপার্টের পরামর্শে নিজেদের ভুল জায়গায় আত্মবিশ্বাসকে আরেকটু তৃপ্তির সাথে মজবুত করে নিই আমরা।
ইসলামিক সমাজে খুব প্রচলিত একটা চিন্তা হলো, সন্তানকে শুধুমাত্র এবং শুধুমাত্র ‘ইসলামি সাহিত্য’ পড়িয়ে বড় করতে হবে, এর বাইরে যেকোন গল্প কবিতা প্রবন্ধ পড়া তার জন্য নিছক সময় নষ্ট। বিশেষত তা যদি ‘শিক্ষামূলক’ না হয়। কেননা, বিনোদন ছাড়া সাহিত্য পড়ার একমাত্র ভালো দিক আমাদের কাছে, নৈতিকতা তৈরির জন্য শিক্ষা গ্রহণ। অতএব, বয়স শুণ্য থেকে শুরু করেই তাদের সাথে নবী রাসূল, সাহাবী, তাবেঈ, আলিম ওলামা, সৎ কর্মশীলদের জীবনী, ইসলামের ইতিহাস বাদে আর কিছু পড়ানো দরকার নেই।
আমাদের প্রথম ভুলটা হলো, আমরা বাচ্চাদের ‘শিক্ষামূলক’ কিছু দিতে চাই। কিন্তু শিক্ষার সংজ্ঞাই আমাদের কাছে পরিষ্কার না। ইসলাম শিক্ষা মানে শুধু মাত্র নৈতিক শিক্ষা না। শিক্ষা একটা লম্বা চওড়া ট্রেইনিং প্রসেস। যেটা পরবর্তী জীবনে বাঁচার মত বাঁচতে আমাদের সাহায্য করে। আমি খুব সহজ কিছু উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি কিভাবে সেক্যুলার সাহিত্যের বিভিন্ন দিক উপেক্ষা করার মাধ্যমে আমরা আমাদের ‘ইসলাম শিক্ষাকে’ পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
১.
জীবন ঘনিষ্ট অনেক গল্প আমাদের অন্যের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করার শক্তি তৈরি করে। এর জন্য বিভিন্ন সমাজের, বিভিন্ন পরিস্থিতির, বিভিন্ন পটভূমিতে লেখা বিভিন্ন রকমের গল্প পড়া দরকার। সেখানে অনেক মজলুমের দুঃখের গল্প থাকবে, জালিমের অট্টহাসির গল্প থাকবে, কোন গল্প পড়তে গিয়ে হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে যাবে, কোন গল্প কাঁদাবে, কোনটা আবার উত্তেজনায় ঘুম কেড়ে নেবে। এভাবে নিজের অজান্তেই বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নিজেকে কল্পনা করার শক্তিটা ধীরে ধীরে তৈরি হবে। উপরের উদাহরণের শায়খের মত কারো পরিস্থিতিকে বোঝার আগেই ফতোয়া দিয়ে নিজের ও অন্যের ধ্বংস সে ডেকে আনবে না।
উল্লেখ্য, এই ট্রেইনিং শুধুমাত্র সাহিত্য দিয়েই হবে, টিপিকাল ছোটদের ইসলামি সাহিত্য না, জীবনঘনিষ্ট সাহিত্য। একটা শিশু আরেকটা শিশুর গল্প পড়বে, বুঝবে। তার বাসার পাশে বস্তির খেটে খাওয়া লোকটার গল্প পড়বে। হাজার বছর আগের নবী রাসূলের(আঃ) গল্প তাকে নৈতিক শিক্ষা দেবে, কিন্তু ‘অন্যের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করার’ গুরুত্বপূর্ণ মানসিক ট্রেইনিং দেবে না।
২.
ভালো সাহিত্য আর মামুলি লেখার পার্থক্য বুঝতে হলে প্রচুর ভালো সাহিত্য পড়ে নিজের রুচিকে গড়ে তুলতে হয়। কুরআনের সাহিত্যমান সর্বোচ্চ যা মানুষের ক্ষমতার বাইরে। এটা বোঝা আরবদের জন্য কোন ব্যাপারই ছিল না কেননা তারা সাহিত্যপ্রেমী জাতি। মানুষের ক্ষমতার শেষ কোথায় তারা জানে বলেই আল্লাহর কালাম তাদের অবাক করেছিল।
আমরা যদি চাই যে আমাদের ছেলেমেয়েরা কুরয়ান যে ঐশিবাণী এটা কোন সায়েন্টিফিক প্রমাণ ছাড়া শুধু রিডিং পড়েই এর ভাষাগত উচ্চতা দেখার সাথে সাথে টের পাবে, তাহলে মানুষের মধ্যে যারা সর্বোচ্চ মানের কালজয়ী সাহিত্যিক, তাদের কালজয়ী সাহিত্যকর্ম বাচ্চাদের পড়ানোর মাধ্যমে তাদের সাহিত্যের উচ্চমানের রুচি গড়ে তুলতে হবে, প্রচুর শক্তিশালী লেখকের বই পড়াতে হবে, যাতে কুরয়ান তাদের ভাষা দিয়ে মুগ্ধ করে। আলেমদের মতে, কুরয়ানের মু’জিযা হলো এর ভাষাগত মু’জিযা।
আল্লাহ কুরয়ানে বারবার এর সমমানের কিছু এনে দেখানোর চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন আমাদের দিকে, যেটার কোন রেলেভেন্স, আমাদের নিজেদের ব্যর্থতার কারণে আমরা নিজেদের জীবনে পাইনা। আমাদের বাচ্চাদের কাছেও কি কুরয়ানের এ আয়াতগুলো ইরেলেভেন্টই থেকে যাবে? কালজয়ী সাহিত্য পড়ার কাজটা যদিও আরবীতে সবচেয়ে ভালো হতে পারে, সেই বয়স বা সুযোগ আসার আগ পর্যন্ত বাচ্চাদের বসিয়ে না রেখে অন্য ভাষাতেও চেষ্টা হওয়াটা বৃথা না।
৩.
রূপকথা, সায়েন্স ফিকশনের ‘অসম্ভব’ গল্প তাদের নিজেদের বাস্তবতার বাইরে যেয়ে কল্পনা করতে শেখায়। কল্পনাশক্তির সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটে নিজের স্থান, কাল ও বাস্তবতা তিনটারই বাইরে গিয়ে কল্পনা করলে। যেটা খুব কম ইসলামিক গল্পেই হয়ে থাকে। এই কল্পনাশক্তি পরবর্তী বয়সে তাদের গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যার বিভিন্ন শাখা নিয়ে সাবলীলভাবে পড়াশোনা করার প্রধান গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।
কয়েক শ’ রূপকথা বা সায়েন্স ফিকশনের গল্পের বিকল্প কখনই হাতে গোণা বিশটা বা পঞ্চাশটা নবী রাসূলের মু’জিযার গল্প বা কারামাহর বর্ণনা হতে পারে না। ইসলামী গল্প আমরা পড়াবো, কিন্তু এগুলো থেকেও বঞ্চিত করবো না। একজন বাচ্চা যত বেশি বই পড়বে, তার কল্পনার ডানা তত প্রসারিত হবে। এই ডানা কেটে আমরা যেন শুধু অল্প সংখ্যক ইসলামিক গল্পে তাদের আটকে না রাখি।
৪.
গোয়েন্দা কাহিনী, রহস্য গল্প তাদের লজিকাল সেন্স তৈরি করে। বিশ্লেশন ক্ষমতা, রিজনিং তৈরি করে। এই ক্ষমতা একটা নির্দিষ্ট বয়সের আগে কোন ইসলামিক কন্টেন্ট দিয়ে হয় না। এই লজিকাল সেন্স দিয়েই পরবর্তীতে মুজতাহিদ হবার ক্ষমতা তৈরি হয়। এই মানসিক ট্রেইনিং ছাড়া ব্যাক্তিকে দেখলে বুদ্ধিহীন জড় পদার্থ মনে হবে না যদিও, কিন্তু এটাও ঠিক যে সে একজন মুজতাহিদও হতে পারার সম্ভবনা ক্ষীণ।
৫.
আরেকজন জনপ্রিয় ইসলামি বক্তা প্রশ্ন করেছিলেন, যে আমেরিকা পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারে, তাদেরকে কেন আমাদের মত গরীব দেশের কাছ থেকে কাপড় আমদানী করতে হয়? তারা কি সামান্য কাপড়ও বানাতে পারে না? প্রশ্ন শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে বক্তার এ বিষয়ে কোন ধারণাই নেই। আমেরিকা অন্য অনেক অসাধারণ কাপড় বানায়। কিন্তু সেগুলো প্রাকৃতিক সুতি না, ওটা তাদের দেশের আবহাওয়ায় উৎপাদন হয় না। তাই তারা আমাদের দেশ থেকে এক ধরণের সুতি, চায়না থেকে আরেক ধরণের সুতি, মিশর থেকে আরেক ধরণের সুতি আমদানী করে।
এসব জানার জন্য ভুগোল সম্বন্ধে যে জ্ঞান প্রয়োজন, সেটা ভুগোল বইয়ের পাতায় কমই আছে, বরং এগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইতিহাসের গল্ল, সাহিত্যের আর ভ্রমণ কাহিনীর পাতায় পাতায়। বিভিন্ন সংস্কৃতি ও সভ্যতা নিয়ে জানার জন্য ছোট বয়সে সবচেয়ে উপযোগি মাধ্যম হলো সাহিত্য। এগুলো থেকে বঞ্চিত হলে যত বড় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়া হোক না কেন, অনেক সাধারণ জ্ঞান নাবথাকার কারণে স্কলারশিপ যোজন যোজন দূরে থেকে যাবে।
মস্তিষ্কের ট্রেইনিং এর জন্য সাহিত্যের গুতুত্ব নিয়ে আরো অনেক পয়েন্ট লেখা যায়। লেখা শেষ হবে না। আমি এখানে কবিতার গুরুত্ব নিয়ে কোন কথাই বলিনি, বলতে গেলে আরো দুটো পর্ব লাগবে কমপক্ষে। উল্লেখ্য, উপরের কোন স্কিলই হালাক্বায় নিয়ে লেকচার দিয়ে বাচ্চাদের শেখানো যাবে না। কেননা সেই শিক্ষাই সবচেয়ে মজবুত, যা মানুষ নিজের অজান্তেই শেখে, আনন্দের সাথে শেখে। হরেক রকম শিল্প আর সাহিত্যের চেয়ে বেশি আনন্দ আর কিসে হতে পারে?
এই স্কিলগুলো অর্জনের সময় বয়স শুণ্য থেকে শুরু করে পুরো শৈশব, কৈশর। ততদিনে তার অপরিপক্ব মন তৈরি হতে থাকবে ইসলামী জ্ঞানের শাখাগুলোতে সমস্ত শক্তি নিয়ে বিচরণ করতে। এরপর অন্যদের চেয়ে অনেক গুণ তীব্রতর গতিতে, তীক্ষ্ণতর মেধা নিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে ইসলামী ও সেক্যুলার জ্ঞানের সাগরে। তা না করে যদি ছেলেবেলার পুরো কারিকুলামই আমরা ইসলামি সাহিত্য দিয়ে ছেয়ে ফেলি, যেগুলোর জন্য তখন সে পুরোপুরি প্রস্তুতও না, তাহলে লং রানে তার ইসলামী জ্ঞানেই আমরা পিছিয়ে যাওয়ার রাস্তাটা তৈরি করে ফেলি।
পরবর্তী পর্বে ইন শা আল্লাহ উলামাদের জীবনী থেকে এ প্রসঙ্গে উদাহরণ এনে সেগুলোর কিছুটা পর্যালোচনা করার চেষ্টা করবো।