প্রায়শই বুকের দুধ খাওয়ানো নতুন মায়েদের বলতে শোনা যায়, বাচ্চা ব্রেষ্টফিড করতে চায় না, বুকের কাছে আনলেই কান্না করে। বাচ্চার পেট ভরে না, তাই কান্না করতেই থাকে। সংবেদনশীল এই সময়টিতে বাচ্চার মা, বাবা আর পরিবারের অন্যরা ফিডার দিয়ে দেন, তা সেই ফিডারে এক্সপ্রেস করা মায়ের বুকের দুধ থাকুক, কিংবা ফর্মূলা। সমস্যা তখনি হয়, যখন ব্রেষ্টফিডিং এবং ফিডারে খাওয়ানো সমান তালে চলতে থাকে।

নতুন শিশুটিও দ্বিধার মধ্যে পড়ে যায়, কোন নিপল সে চায়, মায়ের বুকের দুধের নাকি ফিডারের। এর নাম “নিপল কনফিউশন”। যখন ব্রেষ্টফিডিং এর সাথে বাচ্চা পরিপূর্নভাবে অভ্যস্থ হওয়ার আগেই সে ফিডারে খাওয়া শুরু করে, কিংবা শুরুতেই বাচ্চা খুব বেশি প্যাসিফায়ার চুষনি) বা ড্যামিতে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে, তখন সাধারনত এই সমস্যাটির সূত্রপাত ঘটে।

কেন হয় নিপল কনফিউশন?

বাচ্চা যখন মায়ের বুক থেকে দুধ টেনে খায়, তার মেকানিজম ফিডার থেকে দুধ টেনে খাওয়া থাকে সম্পূর্ন ভিন্ন । বাচ্চাকে যখন ব্রেষ্টফিডিং আর ফিডার উভয়ের মাধ্যমে দুধ দেয়া হয়, তখন বাচ্চা দ্বিধান্বিত হয়ে যায় দুই ধরনের নিপল নিয়ে। যদিও এখনকার সময়ের ফিডারগুলো বলা হয়ে থাকে এমনভাবে ডিজাইন করা যে তা মায়ের নিপলের মতোই।

আসলে দেখতে প্রাকৃতিক নিপলের মতো হলেও এখানে বাচ্চার দুধ টেনে খাওয়ার মেকানিজম ভিন্ন দেখে, কখনোই তা মায়ের নিপলের বিকল্প হতে পারে না। এরকম অবস্থায় একবার ব্রেষ্টফিডিং, আরেকবার ফিডার দেয়া বলে, বাচ্চা দ্বিধান্বিত হওয়া অস্বাভাবিক না। সব বাচ্চারই যে নিপল কনফিউশন হয়, তাও না। তবে অনেক বাচ্চাদেরই এটা হয়।

সাধারনত বাচ্চা জন্মের পর মায়ের বুকে দুধ আসতে সময় লাগে। প্রাকৃতিক প্রসবের চাইতে সিজারিয়ানের ক্ষেত্রে আরও কিছু বেশি সময় লাগতে পারে। এই সময় ধৈর্য্য ধরে বাচ্চাকে বারবার মায়ের বুক চুষতে (Suck) দেয়া উচিত। কিন্তু এই ক্রিটিকাল সময়ে যখনি বাচ্চাকে ফিডারে খাবার দিয়ে দেয়া হয়, তখন নিপল কনফিউশন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।

সাধারনত যেসব বাচ্চারা সময়ের আগেই জন্ম নেয় বা যাদের দুধ টেনে খাওয়ার সক্ষমতা কম থাকে বা সাকলিং দূর্বল হয়, সেসব বাচ্চাদের নিপল কনফিউশনে পড়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। 

নিপল কনফিউশনে ভোগা বাচ্চারা ব্রেষ্টফিডিং এর সময় কান্নাকাটি করে, মায়ের নিপল দৃঢতার সাথে মুখে নেয় না (Latching), মায়ের মনে হতে থাকে ঠিকমতো বাচ্চা ঠিকমতো ব্রেষ্টফিড করছে না, এমনকি বাচ্চা মায়ের স্তন প্রত্যাখ্যানও করতে পারে। তবে সুখবর হলো, যেসব বাচ্চাদের একবার নিপল কনফিউশন হয়, তারা আবার ব্রেষ্টফিডিং এ ফেরত আসতে পারে। প্রয়োজন মায়ের ধৈর্য্য আর কিছু টিপস ফলো করা।

মায়েদের জন্য টিপস

  • যথাযথভাবে বুকের দুধ আসা এবং বাচ্চা খাওয়ায় অভ্যস্থ হওয়ার আগে বাচ্চাকে ফিডার বা প্যাসিফায়ার দেয়া থেকে বিরত থাকুন। যদি বাচ্চাকে ফিডার দিবেন বলে চিন্তা করেন, তাহলে অন্তত বাচ্চা ব্রেষ্টফিডিং এ অভ্যস্থ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
  • বাচ্চার জন্মের পরপর বাচ্চাকে মায়ের ত্বকের স্পর্শ (Skin to Skin) দিন। বাচ্চাকে মায়ের কিংবা বাবার গায়ের চামড়ার সংস্পর্শে রাখুন বেশি বেশি।
  • দুধ খাওয়ানোর সময় পজিশন ঠিক রাখুন। বাচ্চার পেট আপনার পেট বরাবর, সমান্তরাল শরীর, মাথা কিঞ্চিৎ পেছনের দিকে ঝুঁকানো, নাক নিপল বরাবর থাকবে।
  • ল্যাচিং ঠিক রাখার চেষ্টা করুন। বাচ্চার মুখ সম্পূর্ন খোলা, এরিওলা (ব্রেষ্টের কালো অংশ) পুরোটা তার মুখের ভিতর থাকবে। মনে রাখবেন, নিপল সাকিং এ বাচ্চা যথেষ্ট দুধ পায় না।
  • বাচ্চা যখনি ক্ষুধার্ত হবে (ঘুম ভেঙ্গে উঠবে, মুখ নাড়াবে, হাত চুষবে), তখনি ব্রেস্ট অফার করবেন। বাচ্চা খুব ক্ষুধার্ত হয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন না।
  • ব্রেস্টফিডিং এর সময় ব্রেষ্টের চারপাশে হাত দিয়ে রাখুন। যখনি বাচ্চা সাক করা শুরু করবে, হাত দিয়ে চেপে মিল্ক এক্সপ্রেস করার মতো করে বাচ্চাকে এক্টিভ ফিডিং এ সাহায্য করুন। 
  • বাচ্চাকে বারবার ব্রেষ্ট অফার করবেন। কিছুটা মিল্ক এক্সপ্রেস করে এরিওলাতে লাগিয়ে রাখুন। এতে বাচ্চা দুধের গন্ধে আকৃষ্ট হবে।
  • যথাযথভাবে দুধ খাওয়ানো (Breastfeeding establishment) চালু করতে যদি সময় লেগে যায়, তাহলে বুকের দুধ বের করে ছোট্ট প্লাস্টিকের কাপ, সিরিঞ্জ বা চামচে করে খাওয়াতে পারেন।
  • বাচ্চা একান্তই যদি মায়ের নিপল নিতে না চায়, নিপল শিল্ড (ব্রেষ্টের উপর ব্যবহারের পাতলা সিলিকনের শিল্ড)ব্যবহার করে দেখতে পারেন কিছু সময়। কিন্তু এটা সাময়িক।
  • বাচ্চাকে কান্না ছাড়া ঠাণ্ডা রাখতে শুরুতেই রেগুলার প্যাসিফায়ার দেবেন না। এতে বাচ্চা নিজেকে শান্ত করা শিখবে ধীরে ধীরে।
  • ব্রেষ্টফিডিং এ বাচ্চাকে অভ্যস্ত করাতে সময় এবং ধৈর্য্য উভয়ের প্রয়োজন।

অনেক মায়েরাই মনে করেন, বাচ্চাকে শুরুতে ফিডার না দিলে বাচ্চা ফিডারে অভ্যস্থ হবে না। অনেক সময় কম সময়ের মধ্যে কাজে ফেরা মায়েরা ভাবেন ফিডারে না খেলে বাচ্চা না খেয়ে থাকবে। এটা ভুল ধারনা। ব্রেষ্টফিডিং এস্টেবলিশের আগে ফিডারের ব্যবহারে নিপল কনফিউশনের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। কিছুটা সময় নিলেই এই সমস্যা এড়ানো যায়।

আবার যারা নিয়মিত বাচ্চাকে শান্ত করতে শুরুতেই প্যাসিফায়ার বা ড্যামি দেন, তারাও এই সমস্যায় পড়ার সম্ভাবনায় থাকেন। এতে বাচ্চা নিজেকে কিভাবে শান্ত রাখতে হয়, সেটা শিখতে পারে না সহজে। ছোট ছোট সামান্য কিছু টিপস সাহায্য করবে আপনাকে নতুন মা হিসেবে বাচ্চার নিপল কনফিউশন দূর করতে।

তথ্যসূত্রঃ লা লিশ লীগ ইন্টারন্যাশনাল  

লেখাটি রিভিউ করেছেন –

ডাঃ মাশরুরা মাহজাবিন
MBBS
General Practioner, Trained Mental health counselor

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা