সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে, বাবা মায়ের কাছে তারা দীর্ঘদিন যাবত ছোট বাবুই রয়ে যায়। আর সেটা যদি হয় একমাত্র সন্তান তাহলে তো কথাই নেই। সেই বাবু যে কবে বড় হয়!
মেয়েদের তাও শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার উসিলায় কিছু কাজ শেখানো হয়। যাদের শেখানো হয় না তারাও বিয়ের পর শিখে নেয়। কিন্তু আমাদের দেশে ছেলেদের জন্য ছোটবেলা থেকে সংসার শুরু করার পরেও কাজকর্মের ব্যাপারে থাকে বিশেষ ছাড়। ছেলেদের জন্য তাই মায়েদেরও চিন্তার শেষ থাকে না। থাকে কাজ না করতে দেওয়ার নানা অজুহাত।
“বাবু তো এখন ছোট, মাত্র ৫ বছর। নিজে নিজে খেতে পারবে না তাই আমি খাইয়ে দেই।”
“বাবু তো এখন ছোট, মাত্র ৮ বছর। ও কী খেলনা গোছাতে পারবে নাকি?”
“বাবু তো এখন ছোট, মাত্র ১০ বছর। সকালে উঠতে অনেক কষ্ট হয়, তাই ফযর পড়তে দিই না। একটা ভাল ট্যাবও কেনা দরকার, পাশের বাসার সুজনের বিশাল ট্যাব দেখে ছেলেটার আমার খুব মন খারাপ হয়!”
“বাবু তো এখন, ছোট মাত্র ১২ বছর। কী কাজ করবে এখন?”
“বাবু তো এখন ছোট, মাত্র ১৫ বছর। ঘর গোছানোর ও কী বোঝে?”
“বাবু তো মাত্র কলেজে উঠলো, এখন একটা দামী মোবাইল না হলে চলে?”
“বাবু তো মাত্র ভার্সিটি তে পা রাখলো এখনই কিসের ইনকাম?”
“বাবুর তো মাত্র ২৩, এখন বাজার করতে পারবে না। আমরা আছি না?”
“বাবুর মাত্র ৩০ হল, টাকা-পয়সা জমি-জমা কিছুই করতে পারেনি, এখনই বিয়ে!?”
সে সব বাবুরা একটা সময় নিজেকে আবিষ্কার করে অলস এবং পরনির্ভরশীল হিসেবে। তখন ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মন মানসিকতা এবং পরবর্তীতে সময় সুযোগের অভাবে আর পরিবর্তন আনাটা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠে না।
আচ্ছা এতে করে বাবুরা কী একলাই সাফার করে? না, সবচেয়ে বেশি সাফার করে বাবুদের সহধর্মিণীরা এবং মাঝে মাঝে মুখে প্রকাশ না করলেও বাবা মা নিজেরাও ভুক্তভোগী হয়ে থাকেন।
আল্লাহর উত্তম নিয়ামত সন্তানদেরকে ঘরে বাবু বানিয়ে রেখে কী লাভ হচ্ছে?
১। বাবা মা অসুস্থ হলে ছেলেরা সেবা করতে পারছে না। বঞ্চিত হচ্ছে অনেক বিশাল একটি ইবাদত থেকে। কারন তাদের কে শেখানোই হয়নি এই সময় কীভাবে তারা কী করবে?
– এ জন্য ছোটকাল থেকে বাবা মা অসুস্থ হলে তাদের সেবা করা সম্পর্কে হাদিস শোনাতে হবে, কীভাবে ছোট ছোট কাজের মাধ্যমেও সেবা করা যেতে পারে সেসব জানাতে হবে। যেমন, মাথা টিপে দেওয়া, শরবত বানিয়ে খাওয়ানো ইত্যাদি।
২. মা অসুস্থ মানে রান্না বান্না ঘরবাড়ির যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়ে থাকে। কারন পুত্র সন্তানরা জানেন না এগুলো কিভাবে ম্যানেজ করতে হয়।
– ছেলে শিশু কথা বলা শিখলেই তাকে দিয়ে ছোট খাটো কাজগুলো করা শিখিয়ে ফেলতে হবে। যেমন, নিজের খেলনা জায়গামত রাখা, নিজের কাপড় নিজের ড্রয়ারে রাখা ইত্যাদি।
৩. মা অসুস্থ মানে ছেলেরা না খেয়ে বসে থাকে, কখন মা তার সর্বোচ্চ শক্তি সঞ্চয় করে বিছানা থেকে উঠে তাদের খাবার বেড়ে দিবেন! অথচ সেই সময় সন্তানদেরই উচিৎ মায়ের মুখে খাবার তুলে দেওয়া।
– ১০ বছর বয়স থেকে ছেলেদের নিজের নাস্তা নিজে বানিয়ে খাওয়া শেখাতে হবে, সেই সাথে খাবার বেড়ে খাওয়া এবং খাওয়া শেষে থালাবাসন জায়গামত রাখার মত হালকা পাতলা কাজগুলিও শেখাতে হবে।
৪. মা বোনদের ঘরের সব কাজ করতে দেখে বড় হওয়া ছেলেটির মাইন্ড সেট হয়ে যায় যে ঘরের কাজ সব মেয়েদেরই দায়িত্ব! যেটা মোটেও সুন্নাতসম্মত না। আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসাল্লাম ঘরে নিজের কাজ নিজে করতেন।
* রাসূল. সা. এর সীরাহ দ্রষ্টব্য।
– এসব ব্যাপারে ক্লিয়ার হওয়ার জন্য ছোট থেকেই বাচ্চাদেরকে রাসূলের সা. সীরাহ পড়ে শোনাতে হবে। উনার আচার আচরণ, কথা বার্তা, কাজ কর্ম সম্পর্কে সব কিছু জানাতে হবে।
৫. বিয়ের পর একটা মেয়ে অকাল সমুদ্রে এসে পড়ে। নতুন মানুষ নতুন বাসা নতুন অভ্যাস। এর উপর তার কাছ থেকে আশা করা হয় সে এক হাতে দশ হাতের কাজ সেড়ে ফেলবে কোন টু শব্দ ছাড়া। রান্না বান্না, সংসার সামলানো, বাচ্চা পালা, অতিথি আপ্যায়ন, আত্বীয়তা রক্ষা, দ্বীন শিক্ষা, পড়াশোনা (অপশনাল!), আবার ক্ষেত্র বিশেষে চাকরি ও করা! মেয়ে কারো সাথে মিশতে পারছে না, মুখ গোমড়া করে রাখে ইত্যাদি সমস্যা তো থাকেই !
– এসব সমস্যার সমাধানে বিয়ের আগেই ছেলেকে বিয়ের ব্যাপারে একটা ধারণা দেওয়া বাবা মায়ের কর্তব্য। একটা মেয়েকে কিভাবে ট্রিট করতে হবে সেটা ছেলেরা যতটা না পড়ে শেখে তার চেয়ে বেশি দেখে শেখে। এই ব্যাপারে তাই বাড়ির কর্তাকে সব সময় বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে।
মেয়েরা ঘর সংসার সামলাবে এটাই তাদের দায়িত্ব। কিন্তু তারা কি একটা সাহায্যের হাত আশা করতে পারে না? রান্না, বাচ্চার কান্না এবং অতিথি আপ্যায়ন নিয়ে যখন সে হিমশিম খাবে তখন অপরপক্ষ কী এক গ্লাস পানি ঢেলে খেতে পারবেন না!? দিন শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন সে ঘরে আসবে তখন বিছানাটা গোছানো কী সে দেখতে পারেনা? প্রতি রাতে মশারি টাংগানো নিয়ে মনমালিন্য করাটা কী খুব জরুরি? দিন শেষে একটা হাত কী তার মাথায় রেখে বলা যায় না, আজকে অনেক কষ্ট করেছো তুমি?
বিশ্বাস করুন, মেয়েরা এর চেয়ে খুব বেশি কিছু স্বামীর কাছে আশা করেনা।
রাসূল সা. এর যুগে যদি ছেলে সন্তানদের “বাবু” বানিয়েই রাখা হতো তবে উসামা বিন যায়েদ সতেরো বছর বয়সে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে পারতেন কী? যে কোন ধরনের কাজই হোক না কেন সেটাতে নেতৃত্ব দেওয়া মানে তার সেই পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব থাকাটা জরুরি। আজকে কয়টা ঘরে আমরা সতেরো বছর বয়সী শক্ত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন পুরুষ মানুষ খুঁজে পাবো?
অল্প বয়সে হাতে ট্যাব, দামী মোবাইল, ল্যাপটপ ইত্যাদি তুলে দিয়ে আসলে কী আমরা তাদের উপকার করছি নাকি ক্ষতি করছি? খুব ছোট থেকেই মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেদেরকেও তাদের সঠিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করাটা জরুরি। কলেজ পড়ুয়া ছেলেদের কে টিউশনি করে নিজের পকেট খরচ চালানোর জন্যেও তৈরি হতে বলাটাও তাদের স্বাবলম্বী করে তোলার প্রথম ধাপ হতে পারে।
আল্লাহ্ সন্তানকে আমাদের কাছে আমানত হিসেবে দিয়েছেন। আমাদের দায়িত্ব তাদেরকে সঠিক পথে চলার শিক্ষা দান করা, স্বনির্ভরশীল এবং স্বাবলম্বি করে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা। ছেলেদেরকে এই শিক্ষা গুলো দেওয়ার মাধ্যমে আমরা শুধু যে তাদের উপকার করছি তা না, আমাদের সাদকায়ে যারিয়ার পথ সহজ করছি এবং অন্য আরেকটি মেয়ের প্রতিও ইহসান করছি! সুবহানআল্লাহ্! আল্লাহ্ নিশ্চয় এর উত্তম প্রতিদান প্রতিটি মাকে দিবেন যারা অন্য আরেকজন মুসলিমের কষ্ট সহজ করতে কাজ করে যাবেন, ইন শা আল্লাহ!
পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের মায়েদের মনে সন্তানরা আজীবন হয়তো বাবুই হয়ে থাকবে। কিন্তু বাস্তবতা ভুলে গেলে তো চলবে না আমাদের, তাই না? বাস্তব জীবনে আমাদের সন্তানরা যেন প্রতিনিয়ত ধাক্কা না খায় সেদিকটাও মাথায় রাখতে হবে!
ছেলে সন্তানকে অতি আদরে বাবু বানিয়ে রাখা কোন কাজের কথা না। বরং তাকে দুনিয়ার কঠিন বাস্তবতার সাথে পরিচিত করিয়ে দেয়া জরুরী
আমরা যেন আমাদের সন্তানদের উত্তম চরিত্রের মুসলিম হিসেবে গড়ে তুলতে পারি, তাদের হাক্ব আদায়ে সচেতন থাকতে পারি এবং ছেলের সহধর্মিণীর প্রতিও ইহসান করে যেতে পারি! আল্লাহ্ আমাদের সকল মায়েদের সেই তৌফিক দিন। আমীন।