গর্ভধারণ খুব স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা। গর্ভধারনের পরিকল্পনার পর অনেক দম্পতি থমকে দাঁড়ান কনসেপশনের জন্য কিভাবে, কী করা উচিত। যারা কন্সিভ করতে চাইছেন, তাদের কিছু বিষয় জানা থাকা দরকার। এটা নিয়ে আমাদের আজকের মাতৃত্বের আয়োজন।
প্রাকৃতিক গর্ভধারণ ( Natural Conception) কি?
প্রাকৃতিক গর্ভধারণ তখনই হয় যখন ইন্টারকোর্স বা শারীরিক মিলনের সময় ইজ্যাকুলেশন বা বীর্য স্খলনের মাধ্যমে শুক্রাণু ভ্যাজাইনাতে (যোনীপথে) প্রবেশ করে এবং ফেলোপিয়ন টিউবে যেয়ে ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে, যা পরবর্তিতে জরায়ুতে প্রতিস্থাপিত হয়ে গর্ভধারন সম্পন্ন হয়।
এই কনসেপশন নির্ভর করে ওভ্যুলেশনের উপর। মাসের নির্দিষ্ট সময়ে ডিম্বাণু যখন বের হয়ে আসে, তখন কার্যকর শুক্রাণুর পক্ষেই সম্ভব একে নিষিক্ত করা।
প্রাকৃতিক গর্ভধারন এক এক দম্পতির জন্য এক এক সময় হতে পারে। কেউ বিয়ের প্রথম ইন্টারকোর্সেই গর্ভধারন করতে পারেন, কারো আবার সময় লাগতে পারে। যেহেতু ওভুলেশন পিরিয়ডের (মাসিক) সাথে সম্পর্কিত এবং বছরে মেয়েদের পিরিয়ড হয় সীমিত, অনেকের সময় লাগে। অনেক ক্ষেত্রে শুক্রাণু দূর্বল হতে পারে, যা প্রাকৃতিক গর্ভধারণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে যেকোনো ফার্টিলিটি ট্রিটমেন্ট শুরু করার আগে অন্তত ৬ মাস প্রাকৃতিক উপায়ে চেষ্টা করা উচিত।
শারীরিক সুস্থতা
প্রাকৃতিক উপায়ে গর্ভধারণ অনেকাংশেই নির্ভর করে শারীরিক সুস্থতার উপর। বাবা মায়ের শারীরিক সুস্থতা জরুরী। ওজন মাত্রাতিরিক্ত কম হওয়া কিংবা বেশি হওয়া দুইই ক্ষতিকর, কেননা এটা ফার্টিলিটির উপর প্রভাব ফেলে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস সহ যেকোন ক্রনিক ডিজিজও এর অন্তরায় হতে পারে।
সুস্থ প্রেগন্যান্সীর জন্য সুস্থতা অপরিহার্য। এই সুস্থতা বজায় রাখার জন্য ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ বার এক্সারসাইজ করতে পারেন। এক্সারসাইজ আমাদের ফুসফুসের কর্মদক্ষতা বাড়ায়, মাংসপেশি মজবুত করে, অতিরিক্ত চর্বি গলিয়ে ওজন কমাতে সাহায্য করে। শারীরিক সুস্থতা প্রাকৃতিক গর্ভধারণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে।
যে কোন অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস কিংবা জীবনাচরণ, যা ফার্টিলিটি কমিয়ে দেয়, সেগুলোকে জীবন থেকে সরিয়ে ফেলতে চেষ্টা করুন। ধূমপান, মদ্যপান, ড্রাগস, এমনকি মাত্রাতিরিক্ত ক্যাফেইন পর্যন্ত ক্ষতিকর। জাংক ফুড বা ফাস্ট ফুডও প্রভাব ফেলে৷
ছেলেদের জন্য টাইট ফিটিং কাপড় পরা, এমনকি দিনের বেশির ভাগ সময় সেলফোন প্যান্টের পকেটে রাখা, ফার্টিলিটি কমিয়ে দিতে পারে বলে গবেষণায় এসেছে। যেকোন সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ (যৌনরোগ) টিউবাল ফ্যক্টর ইনফার্টিলিটি (ফেলোপিয়ন টিউবের ক্ষতিগ্রস্থতার কারনে গর্ভধারনে সমস্য হওয়া) বাড়াতে পারে।
ডাক্তারের কাছে প্রি-কন্সেপশন চেক আপের জন্য যেতে পারেন। অনেক ওষুধ থাকে যা হয়ত আপনি খাচ্ছেন, যেগুলো কনসেপশনে বাধা দেয়, এমনকি প্রেগন্যান্সিতে চালিয়ে যাওয়া ক্ষতিকর। তাই যদি আগে থেকে যদি কোন ওষুধ খেতে থাকেন, প্রাকৃতিক উপায়ে গর্ভধারণ করতে চাইলে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নিন। জাংক খাবার (ফাস্টফুড) থেকে সরে পুষ্টিকর খাবারের অভ্যাস গড়ে তুলুন।
আমাদের এখনকার সময়ের লাইফস্টাইলও ইনফার্টিলিটির পিছনে দায়ী। অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস যেমনঃ কম ঘুমানো, এক্সারসাইজ না করা, পারিবারিক কিংবা কর্মক্ষেত্রের অতিরিক্ত চাপ, ক্ষতিকারক ক্যামিকেলের ব্যবহার ইত্যাদি প্রাকৃতিক গর্ভধারণ প্রতিহত করে। রাত জাগার কারনে ঠিকমতো ঘুম হয় না অনেকের, যাতে শরীরের এড্রেনালিন, করটিসল হরমোন ঠিকমতো কাজ করে না, ইনসুলিন ভারসাম্যপূর্ণ থাকে না। এগুলো কনসেপশনকে কঠিন করে ফেলে। নিয়মিত ঘুম জরুরী। বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত পরিষ্কারক ক্যামিকেল, এমনকি সৌন্দর্য্যবর্ধনে ব্যবহৃত প্রসাধন সামগ্রীতে যে ক্যামিকেল ব্যবহার হয়, এর অনেকগুলোই ক্ষতিকর। যে কোন কৃত্রিম ক্যামিকেলের ব্যবহার কমিয়ে প্রাকৃতিক পণ্য ব্যবহারে সচেষ্ট হওয়া উচিত।
ওভ্যুলেশন
যারা কনসিভ করতে চাইছেন, তাদের জন্য ওভ্যুলেশন কখন হবে, সেটা মাথায় রাখা খুব জরুরী। মেয়েদের রেগুলার মিন্সট্রুয়েশন পিরিয়ড সাধারণত ২৮ থেকে ৩২ দিনের হয়ে থাকে।
যদি মেন্সট্রুয়াল সাইকেল ২৮ দিনের হয় অর্থাৎ ২৮ দিন পর পর হয় তাহলে পরের পিরিয়ড শুরুর ১৪+/-২ দিন আগে(১২-১৬তম) দিনে ওভ্যুলেশন হবে৷
যেহেতু ওভ্যুলেশনের সময়টাতেই গর্ভধারণের ব্যাপারটা ঘটে, এই সময়টা খুঁজে বের করা খুব জরুরী। এই সময়কে মাথায় রেখে শারীরিক সম্পর্কের সময় ঠিক করা উচিত।
কিভাবে ওভ্যুলেশন ট্র্যাক করবেন?
কিছু ফোন এপস পাওয়া যায় সেগুলো মাসিকের হিসাব রাখতে সাহায্য করে। মানে পিরিয়ডের শুরু, শেষের দিন আপনি চিহ্নিত করে রাখতে পারবেন। ভুলে গেলে যাতে সেটা মনে করিয়ে দেয়। এগুলো আপনাকে ওভ্যুলেশন কবে হচ্ছে, মনে করিয়ে দিবে।
আরেকটা হলো ওভ্যুলেশন হলে কিছু শারীরিক পরিবর্তন ঘটে। যেটা থেকে ওভ্যুলেশন হচ্ছে কিনা বোঝা যায়।
যেমন:
১।শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা বর্ধিত অবস্থায় থাকবে।
২।মেয়েদের সার্ভিক্যাল মিউকাস বা সাদা স্রাব এর ধরন পরিবর্তিত হয় ওভ্যুলেশনের সময়। যতই ওভ্যুলেশনের কাছাকাছি সময় আসবে, এই মিউকাস ততই ভেজাভেজা, পিচ্ছিল কিছুটা স্বচ্ছ ঘন (ডিমের সাদা অংশের মতো) আকার ধারণ করতে থাকবে। (অনেকের ধারণা সাদা স্রাব যাওয়া খারাপ কিন্তু এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং মেন্সট্রুয়াল সাইকেলের সাথে এটার ধরণও পরিবর্তন হতে থাকে)
প্রতি মাসে ওভ্যুলেশনের এই লক্ষণগুলো ভালোমতো খেয়াল করলেই আপনি ওভ্যুলেশন ট্র্যাক করতে পারবেন আর সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে পারবেন। এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন আর্টিকেল “সেইফ পিরিয়ড বা নিরাপদ দিনগুলো কিভাবে বুঝবেন?“
জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি বন্ধ করুন
প্রাকৃতিক গর্ভধারণ চাইলে, প্ল্যান করার সাথে সাথেই জন্ম নিয়ন্ত্রণের যে পদ্ধতি অবলম্বন করছিলেন, তা বন্ধ করুন। বিশেষ করে খাবার পিল বা ইনজেকশন অনেকটাই হরমোনের সাথে জড়িত। সাধারনত এই ধরনের জিনিস বন্ধ করার পর পিরিয়ডের কয়েকটা সাইকেল লেগে যায় ওভ্যুলেশন নিয়মিত হতে, যা প্রেগন্যান্সির জন্য জরুরী। যেহেতু অনেকের ক্ষেত্রে ওভ্যুলেশন ট্র্যাক করা সহজ নয় (অনিয়মিত পিরিয়ডের ক্ষেত্রে), আপনাকে মাথায় রাখতে হবে পরবর্তী পিরিয়ডের আগেই কন্সেপশন দরকার। তাই সময় হাতে রেখে আগে থেকেই বার্থ কন্ট্রোল থেকে সরে আসুন।
এক্ষেত্রে জেনে রাখা দরকার অনেকে পিরিয়ড নিয়মিত হওয়ার জন্য বা জরায়ুর কোন সমস্যার জন্য ওষুধ /পিল খান। এসব গর্ভধারণে বাধা দেয়৷ কিন্তু বন্ধ করার আগে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন এবং গর্ভধারণের ব্যাপারে আলাপ করুন৷
সহবাস ঠিক সময়ে
ওভ্যুলেশনের সময় কিংবা তার পরপর, যখন কনসেপশনের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে, সে সময় সহবাসের পরিকল্পনা করা যায়। যাদের পিরিয়ড রেগুলার (২৮-৩২ দিনের), তাদের জন্য উর্বর সময় (ফার্টিলিটি উইন্ডো) ট্র্যাক করা সহজ। ওভ্যুলেশন সাধারনত সাইকেলের ১১ এবং ২১ তম দিনের মধ্যে ঘটে থাকে। সহবাসের পরও স্পার্ম সাধারনত শরীরের ভেতরে প্রবেশের ২/৩ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকে। এই অপেক্ষমাণ শুক্রাণু সহজেই ডিম্বাণু পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম। মনে রাখবেন, ডিম্বাণু বের হওয়ার পর ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা টিকে থাকে। এই সময়ের মধ্যে যদি শুক্রাণু থেকে থাকে, তাহলেই নিষিক্তকরনের ঘটনা ঘটবে।
ওভ্যুলেশনের আগেই সহবাস একটা উপায় হতে পারে। এতে ডিম্বাণু বের হওয়ার সাথে সাথে শুক্রাণু প্রস্তুত থাকবে। গতানুগতিক ২৮ দিনের সাইকেলে (১৪ তম দিনে ওভ্যুলেশন হবে) যা করা যেতে পারে, তা হলো, পিরিয়ড শেষ হাওয়ার সাথে সাথে সপ্তাহে কয়েক বার সহবাস করা, যাতে করে ফার্টিলিটি ইউন্ডোর সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায়। সপ্তাহে কয়েকবার সহবাস শুক্রানুর পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করবে। রিকমেন্ডেশন হল ১ দিন পর পর ইন্টারকোর্স করা৷
অনেকে সহবাসে লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করেন, যা শুক্রাণুর গুনগত মানের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। কনসেপশনের চেষ্টার এই সময়টাতে এটি ব্যবহার না করাই ভালো।
সহবাসের সবচেয়ে ভালো সময় এবং পজিশন
কিছু বিশেষজ্ঞরা প্রাকৃতিক গর্ভধারণের জন্য ঘুমানোর আগে সহবাসকে কার্যকর বলেছেন, আবার কেউ বলেছেন সকাল বেলায় স্পার্ম কাউন্টিং সবচেয়ে বেশি থাকে। যে কোন পজিশনে প্রাকৃতিক গর্ভধারণ সম্ভব। তবে সহবাস শেষে পিঠে ভর দিয়ে শুয়ে থাকাকে অনেকেই কার্যকর বলেছেন। কারন সাধারনত যোনিপথ নীচের দিকে ঢালু থাকে। সেক্ষেত্রে সহবাস শেষে চিত হয়ে শোয়া, এই ঢালু পথ বেয়ে শুক্রাণু যাতে সহজে ডিম্বাণু পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে, তাতে সাহায্য করে। অনেকেই সহবাসের পর সাথে সাথেই বাথরুমে না যেয়ে, ১০-১৫ মিনিট বিছানায় অপেক্ষা করতে পরামর্শ দেন। এতে যেসব শুক্রাণু সার্ভিক্সে থাকার, সেগুলো ভেতরে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
উল্লেখ্য সিমেন বা বীর্য যতটুকু ভেতরে যায় তার অনেকটাই আবার যোনীপথ দিয়ে বের হয়ে আসে৷ তাই অনেকে ভাবেন এজন্য কনসেপশন হচ্ছে না৷ এটা ভুল ধারণা ৷ বীর্যে থাকা স্পার্ম বা শুক্রাণু ঠিকই জরায়ু পথে চলে যায়, শুধু খালি সিমেনটা বের হয়ে আসে। তাই এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই৷
মানসিক চাপ নেবেন না
স্ট্রেসের সাথে ওভ্যুলেশনের সংযোগ আছে। অনেকেই বাচ্চা হওয়া নিয়ে পারিবারিক প্রেশারে মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন। কিন্তু যত বেশি স্ট্রেস, তত তা আপনার শরীরের উপর প্রভাব ফেলবে। স্ট্রেস মুক্ত থাকার চেষ্টা করবেন। যত বেশি চাপ মুক্ত থাকতে পারবেন, তত কনসেপশনের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। তবে আমরা যত রকম চেষ্টাই করি না কেন, কনসেপশনের গোটা ব্যাপারটাই সৃষ্টিকর্তার হাতে। হতাশ হবেন না। তাঁর প্রতি বিশ্বাস রাখুন, আর স্ট্রেস হতে পারে, এমন নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এড়িয়ে চলুন।
প্রাকৃতিক উপায়ে গর্ভধারনের জন্য স্বামী-স্ত্রী দুইজনকেই সচেষ্ট হতে হবে প্রথম থেকেই। এর মধ্যে স্বামীর করণীয় কিছু ব্যাপার আছে যা সুস্থ শুক্রাণু প্রদানে সক্ষমতা বাড়াবে, আবার স্ত্রীরও করণীয় আছে প্রজনন ক্ষমতা কার্যকর রাখতে। ওজনের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক বিএমআই ১৯-২৫ হচ্ছে আদর্শ মহিলাদের কনসিভ করার জন্য যা উচ্চতা অনুযায়ী ওজন থেকে পরিমাপ করা হয়।
একইভাবে মাত্রাতিরিক্ত স্থুলতা বা ক্ষীণ স্বাস্থ্যও পুরুষদের স্পার্মকে প্রভাবিত করে। সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে নিয়মিত ব্যয়াম, পুষ্টিকর ও ব্যালেন্সড ডায়েট স্বামী-স্ত্রী দুইজনের জন্যই জরুরী।
তথ্যসূত্র
১. আমেরিকান প্রেগন্যানিস ডট ওরগ
২. ওয়েব মেড ডট কম
৩. প্যারেন্টস ডট কম
লেখাটি রিভিউ করেছেন –
ডাঃ সাবেরিনা সালাম সারাহ
MBBS, PGT (Pediatrics)
Medical Officer, Pediatrics & Neonatology Department, Bangladesh Specialized Hospital