প্যারেন্টিং এর উপর একটা লেকচারে শুনেছিলাম: প্রথম ৭ বছর আপনার সন্তানের সাথে খেলা করুন, দ্বিতীয় ৭ বছর তাকে ডিসিপ্লিন শেখান, তৃতীয় ৭ বছর তার বন্ধু হয়ে যান।
টিনেইজ নিয়ে মোহাম্মাদ আকরাম বশীর ও রিদা বশীর এর একটা বই পড়ছি, ওখানে টিনেইজ সময়টাকে ৩টি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে –
- আর্লি টিনেইজ: ১২- ১৫ বছর
- মিডল টিনেইজ: ১৫- ১৮ বছর
- লেট টিনেইজ: ১৮- ২০ বছর
একেকটা পর্যায়ের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও আচরন রয়েছে, মোদ্দাকথা যেটি তা হলো, বয়ঃসন্ধির এই বয়সটাতে সন্তানকে খুব বেশি শাসন করে কিংবা ‘পাওয়ার স্ট্রাগল’ এ জড়িয়ে লাভ নেই; এই সময়টিতে মূলত আমাদের আচরন হবে তাদের বন্ধুসুলভ, গাইডসুলভ কিংবা কনসালট্যান্টের মত, যে কিনা কিশোরের চিন্তাগুলোকে সম্মান দিয়েই নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু পরামর্শ দেবে। এই বয়সটিতে সন্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া মানে আদতে নিয়ন্ত্রণ হারানো কিংবা সন্তানের সাথে মধুর সম্পর্কের ভরাডুবি….
চিন্তা করে দেখলাম, কথাগুলো বিলিয়ন ডলার এডভাইস সমতুল্য। আমার চারপাশে যেসব বাবামায়েদের দেখি, সারাদিন সন্তানদের ‘বেয়াদব’ ‘বেয়াদব’ বলে গাল দিতে থাকেন, এদের প্রত্যেকেই গাছের গোড়ায় পানি ঢালতে ব্যর্থ হয়েছেন। তা কেমন? খেয়াল করে দেখবেন, যে ৭-১৪ বছরের সময়টিকে সন্তানের শাসনের অর্থাৎ আদব-কায়দা শেখানোর বয়স বলা হয়েছে, সেই গুরুত্বপূর্ণ সময়টিকেই অধিকাংশ বাবা মায়েরা আদরের আতিশয্যে সন্তানকে মাথায় তোলেন, তার যৌক্তিক- অযৌক্তিক সব ধরণের দাবি দাওয়া মেনে নেন, শাসনের জায়গাটিতেও এড়িয়ে যান এই বলে ‘ও তো ছোট মানুষ, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে’। উহু, কাচায় না নোয়ালে বাশ, পাকলে করে ঠাস ঠাস। যে সন্তানটি শৈশবে আদব শিখতে পারেনি, কৈশোরে গিয়ে তাকে আর তা শেখানোর সময় নেই, কারণ তখন সে পুরোপুরি আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে৷ এতদিন আপনি যাকে শিখিয়েছেন, সেই সন্তানটি তার আলো ঝলমলে চোখে দেখা নতুন পৃথিবীর সবকিছু আপনাকেই শেখাতে চাইবে, আপনার সব কথা, যুক্তি, বুদ্ধি তার কাছে সেকেলে ঠেকবে। তো আমার মনে হয়, আমাদের দেশের লেখাপড়ার বয়সে যদি হিসেব করি, তাহলে আদব শেখানোর বয়সটা মোটামুটি ক্লাস টু থেকে ক্লাস এইট। এইট-নাইনের দিকে গিয়েই টিনেইজের ধাক্কা শুরু হবে, তা সামাল দিয়ে নতুন কিশোরটিকে আবার পরিণত বিবেকের মানুষ হয়ে উঠতেই ভার্সিটি লাইফে পা দিয়ে ফেলবে। এই সময়টিকেই বলা হয়েছে ‘লেট টিনেইজ’, যখন কিশোরের অনিয়ন্ত্রিত চিন্তা ও কল্পনা একটু একটু করে মার্জিত হতে শুরু করে, চিন্তায় পরিপক্কতা আসে, পরমতের প্রতি সহিষ্ণু হতে শেখে।
তো মোদ্দাকথা যেটা বলতে চাইছি সেটা হচ্ছে, শাসন শুরু হবে কবে থেকে? এরাউন্ড ৭ বছর, ক্লাস ওয়ান/টু এরকম, যখন শিশু মোটামুটি ভালো-মন্দ বুঝতে শিখে যায়। দেখুন, ইসলামও কিন্তু আমাদের এমনটিই শেখায়, শৈশব থেকে বাচ্চারা আনন্দে খেলেধুলে সালাত পড়ে, কিন্তু ৭ বছর বয়সে প্রথন তাকে অফিশিয়ালি সালাত পড়ার নির্দেশ দিতে বলা হয়েছে। এরপর যদি বলতে বলতেও না শোনে? তাহলে ১০ বছর বয়সে প্রহারের অনুমতিও দেয়া হয়েছে। তবে সুন্দর কথায়, উপদেশে কাজ হলে আর প্রহারের পর্যায়ে যাবেন কেন?
শাসনের মোটামুটি শেষ কবে? ক্লাস এইট/নাইন এরকম, মোটামুটি ১৪-১৫ বছর বয়সে। এক শাইখ বলেছিলেন, এ কারণেই আগের যুগে ১৪/১৫ বছর বয়সে সন্তানেরা যে ম্যাচ্যুরিটি অর্জন করতো তা দিয়ে যুদ্ধের সেনাপতিও হতে পারতো। আর এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে পনের বছর বয়সী সন্তানটি নিজ হাতে ভাত তুলেও খেতে পারেনা। আহা, কি ‘আদুরে অযোগ্য’ প্রজন্মের প্যারেন্ট আমরা!
এবার অনেকের মাথায়ই একটা প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে হয়তো: শাসন করা কিংবা আদব শেখানোর উপায় কী? হায়ে হাত তোলা? ‘মাইরের উপর ওষুধ নাই’ থেরাপি? আমি মোটা দাগে বলবো: “না”। আমাকে একটামাত্র উদাহরণ দেখান তো যেখানে রাসূল সা. নিজে তার কোন স্ত্রী বা সন্তানের গায়ে হাত তুলেছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি?? উনি এতগুলো স্ত্রী, সন্তানের ভারবহন করেও যখন কারও গায়ে হাত তোলেননি, আমাদের দু’একটা সন্তান নিয়েই আমরা এত বিরক্ত কেন হয়ে যাচ্ছি? আমাদের নানা-দাদারা সন্তানদের কথায় কথায় পিটিয়ে ছাল তুলে দিয়েছেন, তাই? উনারা তো বউকেও পিটাতেন। উনারা কি রাসূল সা. এর চেয়েও উত্তম পিতা কিংবা স্বামী ছিলেন?
আমি বিগত ২-৩ বছর যাবত দেশি বিদেশী ডজনখানেক প্যারেন্টিং কিতাবাদি পড়ে যা জেনেছি, তার মূলভাব এরকম: যথার্থ শাসন কিংবা আদব শেখানোর প্রথম উপায় হচ্ছে, নিজেরা উত্তম আদর্শ হওয়া। আমি-আপনি যেটা নিজেরাই মানতে পারিনা, ঐ ফাকা বুলি সারাজীবন দিলেও কাজ হবেনা, বাচ্চারা চোখ দিয়ে শেখে, কান দিয়ে নয়।
আর যেসব বিষয় নরমে কাজ না হয়? সেখানে প্রয়োজনে গরম হউন, কিন্তু হাত চালানোর দরকার নেই। যে কাজটি নিষেধ, সেই কাজ করতে সে যতই ইনিয়ে বিনিয়ে অনুরোধ করুক, ‘শক্ত গলায়’ সেটা নিষেধ করুন, নিজের কথার উপর ইস্তিকামাত থাকুন। কাদে কাদুক, রাগ হয় হউক। যে কাজটি তার জন্য সত্যিই ক্ষতিকর, সেটা তাকে দেওয়া যাবেনা, ব্যস। কেদেকেটে একাই থেমে যাবে, একসময় ওটাকেই মেনে নেবে। কিন্তু কান্না কিংবা ইনিয়ে বিনিয়ে আবদার করার বিনিময়ে যদি একবার অযাচিত আবদার আদায় করে ফেলে, তাহলে এই কান্নাটাকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে, ওটাকেই তখন রিওয়ার্ড হিসেবে সেট করে ফেলবে অবচেতনে। এটাকেই বলা হয় ‘টেম্পার ট্যান্ট্রাম’। শাসনের বয়সে অবশ্যই শাসন করুন, শাসনের জন্যেও সাইকোলজিক্যালি প্রমাণিত অনেকগুলো পন্থাও আছে, সে বিষয়টি অবশ্য আরও বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে।
অনেক মা আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলেন: আমার সন্তানের গায়ে কোনদিন মাছিটি উড়ে বসতে দিইনি। আমার সন্তান কোনদিন হাতে তুলে ভাত খায়নি৷ আমার সন্তানের কোন আবদার কোনদিন অপূরণ রাখিনি….. এই মায়েদের উদ্দেশ্যে শুধু একটা কথাই বলবো: আপনি আপনার সন্তানকে নষ্ট করেছেন, এ ছাড়া কাজের কাজ কিছু করেননি। যে সন্তান শৈশবে এটা ভেবেই নিয়েছে, সে যা চায় তাই পাবে, সে বড় হয়েও ‘চাহিবামাত্র পাওয়া’টাকেই তার অধিকার ভেবে নেবে; প্রয়োজন আর বিলাসিতার মাঝে পার্থক্য করতে শিখবেনা, মা-বাবা কিংবা সমাজের কাছে শুধু পাওয়া নয়, তাদেরকে যে অনেক কিছু দেওয়ারও আছে, এই সত্যগুলো উপলব্ধি করতে পারবেনা৷ এই আপনিই যখন বৃদ্ধ বয়সে ঐ সন্তানের কোন চাহিদা পূরণে অসমর্থ্য হবেন, ঐ সন্তান আপনাকেই তখন আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলবে। অথচ ইসলামের শিক্ষাটা এখানে কতখানি ব্যালেন্সড: বালেগ হওয়ার আগ পর্যন্ত সন্তানের দেখভাল করা যে বাবা-মায়ের দায়িত্ব, সেই বাবা-মা ই বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হয়ে রোজগারে অক্ষম হয়ে গেলে তখন তাদের দেখভাল করা, তাদের ভরণপোষণ দেয়া ছেলেসন্তানের উপর ফরয দায়িত্ব। এই যে দায়িত্বের হাতবদল, শৈশবের পরনির্ভরতা থেকে স্বনির্ভর হয়ে একসময় নিজেই নির্ভরশীলদের অবলম্বন হওয়া, এটাতো একটু একটু করে দায়িত্ব নিতে নিতেই সন্তান শেখে, একদিনেই শিখে ফেলেনা!
ফিরে আসি আগের কথায়: শাসন করতে কি মারধর করাই লাগে? ইসলামে তো প্রহার করার অনুমতি দেয়া হয়েছে! উহু, কড়া কথায়ই ৮০-৯০% কাজ চলে যায়, বুদ্ধি করে পরিস্থিতি বুঝে বলতে পারলে। আর গায়ে হাত তোলা? সমস্ত উপায়ে চেষ্টা করার পরও যখন ব্যর্থ হবেন, এটা কেবল তখনই প্রয়োগ করতে পারবেন। কিন্তু সেই প্রহার করারও আদব আছে, মন চাইলো আর গরুর মত পেটাতে শুরু করলেন, এমনটি কখনো নয়। এতে বরং হিতে বিপরীতই বেশি হয়।
শাসন কি একদম গুণে গুণে ৭ বছরেই শুরু করতে হবে? না, এটা আসলে আকাবিরদের অভিজ্ঞতালব্ধ একটা এস্টিমেশান। এটা হচ্ছে অফিশিয়ালি আদব শেখানোর বয়স। কিন্তু সচেতন বাবা-মা তো এর আগে বসে থাকবেন না, শিশুর বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই নিজেদের কথায়, কাজে, আচরনে তার কাছে একটু একটু করে সত্য-মিথ্যা, সঠিক-ভুলের পার্থক্য তুলে ধরা, বেশি প্রেশার না দিয়ে তার চাওয়া-পাওয়ার লিমিটটুকু আস্তে আস্তে বুঝিয়ে দেওয়া। একদম পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই হঠাৎ করে সপ্তম বছরে গিয়ে শাসন শুরু করে দেবো, এমনটি তো অনেকটাই অবাস্তব, তাইনা??