সিরিজ ইনডেক্স
১. হোমস্কুলিং এর ভালমন্দ
২. আমার হোমস্কুলিং এর আদ্যোপান্ত – প্রথম পর্ব
৩. হোমস্কুলিং ও ইসলাম শিক্ষা
৪. হোমস্কুলিং ও আউটডোর ট্রিপ
৫. হোমস্কুলিংঃ করণীয় ও বর্জণীয়
৬. হোমস্কুলিংঃ অক্ষর শেখানো
৭. হোমস্কুলিং কারিকুলাম যেভাবে তৈরি করবেন?

হোমস্কুলিং কারিকুলাম

যে বিষয়গুলো প্রথমেই বিবেচনা করতে হবে সেগুলো হলো

১. আপনার বাচ্চা ইতোমধ্যেই কী কী জানে/পারে
২. আপনার ওর ব্যপারে সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য কী কী
৩.পড়ার প্রতি বাচ্চার আগ্রহ কতটুকু

আপনার বাচ্চা যা যা জানে সেগুলো বাদ দিয়ে, কারিকুলামের শুরুটা হবে সবার ক্ষেত্রেই প্রায় একইভাবে। সেটা হলো, একেবারে বেসিক জিনিস। যেমন, অক্ষর, সংখ্যা, রঙ ইত্যাদি। বাচ্চা যা জানে, সেগুলো রিপিট করা অপ্রয়োজনীয়। যেমন, দুই-তিন বছরের বাচ্চাদের কারিকুলামে বেসিক রঙ চেনানোটা সাধারণত থাকে, কিন্তু যেই বাচ্চা রঙ চেনে আরো আগে থেকেই, তার কারিকুলামে আপনি কালার ম্যাচিং পাযল টাইপের জিনিসপত্র রাখবেন না। বডি পার্টস চেনে এরকম বাচ্চার হাত পা চোখ মুখের ফ্ল্যাশকার্ড লাগবে না।

বেসিক কারিকুলাম প্রায়োরিটির দিক দিয়ে (সম্পূর্ণ আমার মতামত, এটা কোন স্ট্যান্ডার্ড না) ক্রমানুসারে এরকমঃ

১. অবচেতনভাবে (Subconscious) ভাষা শিক্ষা: ইংলিশ, বাংলা, আরবী যেটাই হোক, বা সবগুলোই। মাধ্যমঃ গল্পের বই পড়া, ঐ ভাষায় কথা বলা, ওকে দিয়ে বলানো ইত্যাদি। একান্তই পারা না গেলে ঐ ভাষা বলে এরকম কারো সাথে সময় কাটাতে দেওয়া। তাও পারা না গেলে অডিও শোনানো, যেহেতু ডিভাইস উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি করে তাই শিক্ষামূলক আরবী কার্টুনও আমি ঘন্টার পর ঘন্টা দেখানোর পক্ষপাতি নই।

২.ফাইন মোটর স্কিল: আপনার ইচ্ছামত ঘরের কাজ করতে দেবেন। মাঝে মাঝে দুই ডিজাইনের পাস্তা বা দুরকম ডাল/ চাল আর ডাল/ অনেক রকম বাদাম মিশিয়ে আলাদা করতে দেয়া, বোতলে সাবধানে পানি ঢালা(বাইরে না ফেলে) প্র‍্যাক্টিস করানোসহ অগণিত আইডিয়া আছে ইন্টারনেটে।

৩.সোশ্যাল স্কিল
৪.কুরআন শোনা/পড়া
৫.অক্ষর চেনানো(বাংলা, ইংলিশ, আরবী)
৬.সংখ্যা চেনানো
৭.রং, শেইপ চেনানো
৮. পশু, পাখি, ফলমূল, সবজির নাম চেনানো (বাচ্চা যদি পড়া ছাড়া আর কিছু না বোঝে আর আপনিও যদি পড়ানোর আর কিছু না পান)

এর বাইরে আপনি আপনার ইচ্ছা, পছন্দ, লাইফস্টাইল অনুযায়ী সাবজেক্ট অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। যেমন, আপনার বিশাল, গোছানো, পরিচ্ছন্ন রান্নাঘর হলে এবং আপনি যদি রাধুনি বাবু চান, আপনার রান্নার কাজে হেল্প নেয়া এবং ওকে দিয়ে রান্না করানো যেতে পারে। আপনি দেখিয়ে দিবেন, ও কাজ করবে। যেটা পারবে না ওটা আপনি করে দেবেন (যেমন সবজি কাটা, পেঁয়াজ কাটা) কিন্তু ধুতে হবে ওকে। মসলা আপনি চামচ গুনে দেবেন, ও ঢালবে ইত্যাদি। এটা জাস্ট আপনার ইচ্ছা। কোন বাঁধা ধরা নিয়ম নেই।

কেউ কেউ আবার ভুগোলপ্রেমী। এই বয়সের বাচ্চাদেরও ম্যাপ চেনান (চেনালে বাচ্চারা সবই চেনে, ম্যাপও চেনে). কেউ সৌরজগতের গ্রহ নক্ষত্র চেনান। যার যার রুচি, পছন্দ যেরকম।

আপনি বাচ্চাকে নিয়ে সুদূরপ্রসারী কী প্ল্যান রাখেন সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।জেনারেল লাইনে শিক্ষিত করতে চাইলে বাংলা ইংলিশে বেশি জোর দিতে হবে। আলিম বানাতে চাইলে আরবীতে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে। খুব খেয়াল করে একদম ছোটবেলা থেকে বেশি বেশি কুরআনের সংস্পর্শে ওকে আনতে হবে। আবার ডাক্তার বানাতে চাইলে ছোটবেলা থেকেই, জ্বি, এই দুই তিন বছর থেকেই মানবদেহ ম্যাথ স্কিল বাড়ানোর বিভিন্ন উপকরণ ওর সামনে আনবেন।

ম্যাথ অনেকের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। কোন কোন বাচ্চার পাযল মিলাতে ভালো লাগে আবার অনেক বাচ্চা সাহিত্যে বা শিল্পকর্মে, ছবি আঁকায়, ক্রাফটে বেশি আগ্রহ দেখায়। বাচ্চার আগ্রহকে গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন সাবজেক্ট অল্প পড়াবেন, কোনটা বেশি। আপনার ইচ্ছা আর বাচ্চার আগ্রহ না মিললে বাচ্চার আগ্রহকেই পারতপক্ষে প্রাধান্য দিন, আপনার আগ্রহের জায়গাটার ব্যপারে ধৈর্য ধরুন, ধীরে আগান আর চেষ্টা করুন সেটার ব্যপারে ওকে উৎসাহিত করতে, সেটাকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলে ধরতে। কিন্তু জোর জবরদস্তি কক্ষণও না।

হতেই পারে কোন বাচ্চা তার বয়সী অন্য বাচ্চাদের চেয়ে অনেক ভালো ছবি আঁকে(যেটায় আপনার আগ্রহ নেই) কিন্তু অংকে সে বেশ দুর্বল। তাকে ছবি আঁকাতেই বেশি উৎসাহ দিন। তাকে আপনার অনাগ্রহ মোটেও বুঝতে দেবেন না। নিজেকে গুড ফর নাথিং মনে করে অনেক বাচ্চার শৈশব কাটে, সম্ভবনা চাপা পড়ে মরে যায়। অথচ উৎসাহ পেলে তাকে দিয়ে দারুণ কিছু হতে পারতো।

তবে দীর্ঘদিন ধৈর্য ধরতে ধরতে ওর গণিত শেখার বয়স পার করে ফেলতে হবে, তা কিন্তু না। বয়স সাতের পর থেকে ভালো না লাগা সাবজেক্টগুলোও বাচ্চাকে অল্প বিস্তর পড়তে হবে, এই চাপটা তাকে ধীরে ধীরে দেয়া শুরু করতে হবে। তবে অবশ্যই সহনীয় পর্যায়ে। আর সহনীয় পর্যায় কতটুকু? সেই উত্তর আপনার আর বাচ্চার কাছে। পড়ার টেবিলে কোন বাচ্চার চোখ যাতে ছলছল না করে, যত যাই হোক না কেন।

পড়ার প্রতি বাচ্চার আগ্রহও আরেকটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। বাচ্চা যদি পড়ার চেয়ে খেলতে বেশি ভালোবাসে তাহলে ছোট বাচ্চাদের অনেক অনেক সাবজেক্ট পড়ানোর দরকার নেই, একদম বেসিক।

কারিকুলাম তৈরির ক্ষেত্রে আরেকটা ব্যাপার মাথায় রাখা ভালো। সেটা হলো, আমাদের ছোটবেলার জগাখিচুড়ি কারিকুলাম বা এখনকার বেশিরভাগ স্কুলের কারিকুলামে অনেক কিছু থাকে যা প্রায় একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। এগুলো আপনি চাইলে বাদ দিতে পারেন বা আরো ভালো কিছু দিয়ে রিপ্লেস করতে পারেন। যেমন, বাংলা ইংরেজী ছড়া। এগুলোর গুরুত্ব শূন্য না হলেও শূন্যের কাছাকাছি। আমি এগুলোকে রিপ্লেস করেছি নামতা দিয়ে। কেননা আমার বাচ্চা ছন্দে ছন্দে নামতা পড়তে খুব পছন্দ করে, মজা পায়। আর এটা পরেও কাজে লাগবে ইন শা আল্লাহ।

দুই বছরের বাচ্চাকে সাধারণত কেউই নামতা শেখায় না। কিন্তু ঐ যে, ট্রেন্ড ফলো করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নিজের মন যা বলে, বাচ্চা যাতে সাড়া দেয়, তাতেই লেগে থাকা। আপনার বাচ্চার যদি কবিতা বেশি পছন্দ হয়, এমন কবিতা ছন্দে ছন্দে শেখান যা পরেও, সারাজীবন কাজে দেবে। এতো ছোট বাচ্চা কি এত কঠিন কবিতা বুঝবে? না বুঝবে না। আমার মেয়েও নামতা বোঝে না। ছোটবেলার টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টারের মানেই বা আমরা ক’জন তখন জানতাম? এগুলোর মর্মোদ্ধার কিন্তু আমাদের অনেক পরে এসে হয়েছে, বেশিরভাগেরই।

আরেকটা বিবেচ্য বিষয় হলো শর্ট টার্ম লক্ষ্য ঠিক করা, লং টার্ম লক্ষ্যকে সামনে রেখে। আপনার বাচ্চার মেধা আর আগ্রহকে বিবেচনায় রেখে আপনি একটা খসড়া লক্ষ্য ঠিক করবেন, অমুক জিনিসটা শিখতে ‘আপনার বাচ্চার’ কতদিন লাগতে পারে। যেমন, আমার লক্ষ্য থাকে আমার বাচ্চাকে মাসে একটা করে নামতা শিখানোর। উঠতে বসতে প্রায়ই পড়ি, ও নিজেই মনে করিয়ে দেয়। তারপরও সব দিন সমান হয়তো যায় না। সবসময় পরিস্থিতিও একরকম থাকে না। মোটামুটি বিশ দিন থেকে দেড় মাসের মধ্যে একটা নামতা মোটামুটি মুখস্থ করতে পারা আমার মতে, আমার বাচ্চার জন্য গুড প্রগ্রেস। আপনার বাচ্চার জন্য গুড প্রগ্রেস কোনটা সেটা আপনাকে ঠিক করতে হবে এবং সেভাবে চেষ্টা করতে হবে।

সফল কারিকুলামের অনেক বড় একটা বৈশিষ্ট্য হলো এটা সহজেই পরিবর্তনযোগ্য। আজকে আপনার প্ল্যান একরকম তো দু’দিন পরেই হতে পারে অন্যরকম। বাচ্চাকে তার পছন্দ অনুযায়ী ডানা মেলতে দিন। বাচ্চা কারিকুলাম ফলো করবে না, কারিকুলাম বাচ্চাকে ফলো করবে। বাচ্চার আগ্রহের জায়গা বদলালে বদলে যাবে কারিকুলামের চেহারা। কিভাবে? সে উত্তর আপনাকে বের করতে হবে।

অনলাইনে অনেক কারিকুলাম পাওয়া যায়। এগুলোর সাহায্য নিতে পারেন। কিন্তু দিনশেষে নিজেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আত্মবিশ্বাসের সাথে। জন্মের পর থেকেই আপনার বাচ্চাকে সবচেয়ে ভালো যে মানুষটা বোঝেন তিনি হলেন আপনি। সুতরাং বাচ্চার মন পড়তে পারার ব্যপারেও আত্মবিশ্বাসী হোন।

সর্বোপরি, ছোট বাচ্চাদের হোমস্কুলিং এর ক্ষেত্রে কারিকুলাম বিবেচনার গুরুত্ব খুবই নগন্য। অথচ এটা নিয়েই আমাদের ঘুম হারাম হবার দশা। বেশির ভাগ, প্রায় পুরোটা সময়ই বাচ্চাকে ছেড়ে দিন নিজের ইচ্ছেমত। খেলুক, হাসুক, ধুলোর মধ্যে লুটোপুটি করুক, নিজের কল্পনার রাজ্যে ঘুরে বেড়াক, হারিয়ে যাক। খুব মধুর, নির্ভার একটা শৈশবের চেয়ে ভালো কারিকুলাম আর কী আছে!

সম্পাদনা: হাবিবা মুবাশ্বেরা
ছবি কৃতজ্ঞতা: Background vector created by rawpixel.com