
সম্পাদকের নোট: লেখক আরবীভাষী দেশে অবস্থান করছেন, এবং একারণে তাঁর জন্য আরবীতে কথা বলায় গুরুত্বারোপ করা স্বাভাবিক। এছাড়া হোমস্কুলিং বিষয় হিসেবে দীর্ঘ ও গভীর আলোচনার দাবি রাখে এবং লেখক মোটামুটি বিস্তারিত ভাবে লিখেছেন। ফলে এজন্য আমরা লেখাটি একাধিক পর্বে ভাগ করে প্রকাশ করবো।
সিরিজ ইনডেক্স
১. হোমস্কুলিং এর ভালমন্দ
২. আমার হোমস্কুলিং এর আদ্যোপান্ত – প্রথম পর্ব
৩. হোমস্কুলিং ও ইসলাম শিক্ষা
৪. হোমস্কুলিং ও আউটডোর ট্রিপ
৫. হোমস্কুলিংঃ করণীয় ও বর্জণীয়
৬. হোমস্কুলিংঃ অক্ষর শেখানো
৭. হোমস্কুলিং কারিকুলাম যেভাবে তৈরি করবেন?
লেখার শুরুতেই বলে রাখা দরকার হোম স্কুলিং বিষয়ে আমি বিশেষজ্ঞ নই। আমি লিখছি নিছক নিজের খুবই স্বল্প অভিজ্ঞতা, নিজস্ব চিন্তাভাবনা আর টুকটাক ইন্টারনেট নির্ভর তথ্যের ভিত্তিতে। আমি যদিও আমার মেয়েকে হোমস্কুলিং করাচ্ছি, আমি চেষ্টা করছি নিরপেক্ষভাবে দুটো এপ্রোচেরই ভালো খারাপ দিকগুলো তুলে ধরতে।
প্রচলিত স্কুলিং বিষয়ে
এটার ভালো দিক হলো, বাবা মায়ের এফোর্ট অনেক কম দেয়া লাগে, বাচ্চা গড্ডালিকা প্রবাহের সাথে যায় বলে একেবারে কিছু না শেখা বা পুরোপুরি ভ্রষ্ট কারিকুলামে পড়ার সম্ভাবনা নেই, সোশালাইজেশন বা সামাজিক মেলামেশার জন্য আলাদা খাটুনি লাগে না, খেলার মাঠ আছে যেসব স্কুলে তাদের শারীরিক কসরত, সেই সাথে ঘরের বাইরে কাটানো সময়ের ব্যবস্থা স্কুলই করে দেয়। বাবা মা নির্ভার থাকতে পারেন।
খারাপ দিক হলো, বাংলাদেশের কারিকুলাম এবং পদ্ধতি, এমনকি ইসলামিক স্কুলগুলোতেও বাচ্চাদের শেখার সহজাত আগ্রহকে পিষে মেরে ফেলে তাকে কোনক্রমে সার্টিফিকেটটা হাতে নিয়ে তারপর বইগুলো ছুড়ে ফেলে উল্লাস করার স্বপ্ন দেখতে শেখায়। সারা জীবনের জন্য পড়ুয়া, অনুসন্ধিৎসু, বইপোকা বানায় না,( বানালেও শুধু গল্পের বইয়ের পোকা, জ্ঞানজিজ্ঞাসু না), বিশ্লেষণ আর চিন্তার ক্ষমতাকে প্রায় পুরোপুরি নষ্ট করে ফেলে। গরু রচনার প্রথম তিন লাইন আর discipline essay পুরোটা আমার এখনও মুখস্থ আছে, সৃজনশীলতার সুযোগ এখানে নামেমাত্র বা নেই বললেই চলে। আছে সৃজনশীল পদ্ধতি, এস বি এ নামের প্রহসন (কেন প্রহসন তা দীর্ঘ আলোচনা, এখন থাক), আর প্রশ্ন ফাঁসের কথা তো বাদই দিলাম। আমাদের ব্যাচে যারা প্রশ্ন পেয়েছিল কারো বাবা-মা জানেন না। হতেই পারে যে আল্লাহ না করুন আমাদের বাচ্চারাও মাথায় টুপি আর হিজাব পরেই নকল করবে, আমরা টের পাবো না।
অনেকে ভাবেন যে বাসায় ইসলামিক পরিবেশ দেয়াই যথেষ্ট, এটা আমার মতে ঠিক না। কেননা একটা বয়সের পর বাবা মার প্রভাবের চেয়ে স্কুলের সাথীদের প্রভাব বাচ্চার উপর বহুগুন বেশি থাকে। এমনকি আমার জানা বাংলাদেশের সবচেয়ে ভালো ভালো মাদ্রাসাতেও প্রতি ব্যাচে দুই একজন খারাপ পরিবেশের সংস্পর্শে আসা ছেলে/মেয়ে থাকে যারা সবাইকে প্রভাবিত করার জন্য যথেষ্ট। আপনার বাসায় হয়তো টিভিও নেই। ইন্টারনেট খুবই সীমিত। কিন্তু কোন এক দিন আপনার মাদ্রাসা বা ইসলামিক স্কুল পড়ুয়া বাচ্চার কোন এক বন্ধু হঠাৎ অন্য কারো মোবাইলে ঘটনাক্রমে খারাপ দৃশ্য দেখে ফেললো এরপর এতটাই আগ্রহ পেল যে বাতাসের গতিতে এক কান দু’কান করে পুরো ক্লাসে ছড়িয়ে দিল। আপনার ছেলে বা মেয়েটিও কৌতূহলী হলো। তারপর কী ভয়াবহ ব্যপার ঘটতে পারে তা বোঝাই যাচ্ছে।
এছাড়া ছোটখাটো সমস্যার মধ্যে আছে, যে পর্যায়ে বাচ্চাকে পৌঁছাতে স্কুলের লাগে দশ বছর, হোমস্কুলিং এ সেটা পাঁচ বছরের কমেও সম্ভব। অনেক সময় নষ্ট করে অনেক অহেতুক জিনিসে বাচ্চারা ব্যস্ত থাকে স্কুলে।
হোমস্কুলিং এর কথা
স্কুলের সব উপকারীতা এখানে দেয়া সম্ভব, ক্ষতিগুলো এড়িয়ে। কিন্তু তার জন্য আপনাকে বেশ কাঠখড় পোহাতে হবে। আপনার বাচ্চার চাহিদা বুঝে, প্রয়োজন বুঝে মনের মাধুরি মিশিয়ে শেখাবেন। অপ্রয়োজনীয় জিনিসের বোঝা বাদ দিয়ে, প্রয়োজনীয় শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করে। আপনার স্নেহ আর যত্ন বাচ্চাকে পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলবে। ভোরে উঠে চোখ ডলতে ডলতে স্কুলে যাওয়া, বিকেলে বাসায় ফিরেই আবার কোচিং নাহলে বাসার টিচার এত অত্যাচার নেই। স্কুলের অর্ধেক সময়ে যেহেতু বাচ্চাকে নিজে পড়ালে আপনি একই পরিমান বিষয় শেখাতে পারবেন, সুতরাং বাচ্চা নিজে খেলা এবং শখের কাজ করার জন্য যথেষ্ট অবসর পাবে।
পরীক্ষায় খারাপ করার ভীতি, ফার্স্ট হওয়ার চাপ, তিরষ্কার এই ব্যপারগুলো না থাকায় নিজের গতিতে আগাবে। পড়া এবং জানার প্রতি স্বাভাবিক আগ্রহটা হারিয়ে যাবে না। গরু রচনা মুখস্থ করতে হবে না। একটা গরুর সামনে বসে, তাকে ছুঁয়ে দেখে, দুটো গুঁতো খেয়ে দুই লাইন লিখতে পারলেই বাহবা পাবে এবং সে বড় হয়ে কারো রিসার্চ পেপার নকল না করে নিজে রিসার্চ করতে শিখবে। সেই আত্মবিশ্বাস ধীরে ধীরে গড়ে উঠবে হোমস্কুলিং এ। অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ হবার ভয় এখানে সামান্যই। নিজের আগ্রহের জায়গায় কাজ করার সুযোগ এখানে বেশি বলেই হোমস্কুল পড়ুয়া বাচ্চাদের পরবর্তী জীবনে সাফল্যের হার অনেক বেশি।
এতক্ষণ অনেক ভালো ভালো কথা বললাম হোমস্কুলিং নিয়ে। এবার আসি কিছু সতর্কীকরণ কথায়। হোমস্কুলিং এ সোশালাইজেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার বাচ্চার কাছাকাছি বয়সের অন্তত দুই চারজন বাচ্চার সাথে সপ্তাহে অন্তত দশ ঘন্টা একসাথে কোয়ালিটি টাইম কাটাতে হবে/খেলতে হবে। নিয়মিত পার্কে/খোলা মাঠে নিয়ে যেতে হবে। রেগুলার খেলাধুলা করতে হবে। শিক্ষাসফরে নিতে হবে আপনাকেই, প্রায়ই। এগুলো দিতে না পারলে হোমস্কুল আপনার বাচ্চাকে বিকশিত না করে বরং বদ্ধ করে ফেলবে সেই সম্ভবনা প্রবল।
আরেকটা ব্যপার হলো, হোমস্কুলিং এর জন্য আপনার যথেষ্ট দক্ষতা থাকা/গড়ে তোলা। এ বিষয়ে পড়াশোনার বিকল্প নেই। করতেই হবে। নিজের বাচ্চার কারিকুলাম নিজে তৈরি করতে হবে। অন্য মায়েদের সাহায্য নিতে পারেন আইডিয়া নেয়ার ক্ষেত্রে। কিন্তু দিনশেষে আপনি এবং আপনার বাচ্চা মিলে সিদ্ধান্ত নেবেন যে কী পড়াবেন, কী শেখাবেন না। কঠোরভাবে কোন বাঁধাধরা কারিকুলাম অনুসরণ করলে(তা যত আকর্ষনীয় বা প্রতিষ্ঠিত কারিকুলামই হোক না কেন) ভালো ফলাফল আসবে না। অনলাইনে অনেক সম্পূর্ণ কারিকুলাম পাওয়া যায়। Khan academy বেস্ট। এটা সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং একেবারে ফ্রী। কিন্তু ঐ যে বললাম, যত জনপ্রিয়ই হোক, আপনার বাচ্চা না চাইলে পড়াবেন না। আপনি ভালো মনে করলে পড়াবেন, নাহলে পড়াবেন না।
কারিকুলামের চেয়েও যে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো আপনার প্রেজেন্টেশন এবং এপ্রোচ। কী শিখলো সেটার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো কতটুকু চেষ্টা করলো। সেটা আপনার আচরণে ওকে বুঝাতে হবে। চার ঘন্টা ধরে আলিফ চেনানো এবং বিভিন্ন আলিফ সংক্রান্ত এক্টিভিটি করার পর বা দেখিয়ে আলিফ বললে উত্তেজিত হওয়া চলবে না। প্রেজেন্টেশন হতে হবে আকর্ষনীয়। পড়াটাকে দুনিয়ার সবচেয়ে মজার কাজ হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে। পড়ানোর স্টাইল, টেকনিক নিয়ে কাজ করতে হবে। অমনোযোগী বাচ্চাকে লাইনে আনার টেকনিক নিয়ে পড়াশোনা এবং চিন্তা করতে হবে, সময় দিতে হবে।
আপনাকে বিদ্যার সাগর হতে হবে না কিন্তু নিয়মিত পড়াশোনার উপর থাকতে হবে। বাচ্চা যেন গুগল চেনার বয়সে আসলেও গুগলের আগে আপনার কাছে তথ্যের জন্য/বুঝার জন্য আগে আসে। এগুলো করতে না পারলে হোমস্কুলিং তেমন কোন সুফল বয়ে আনবে না।
লেখক: ফারিহা আমাতুর রহমান
সম্পাদনা: হাবিবা মুবাশ্বেরা
You must be logged in to post a comment.