আমরা মাঝেমাঝে খুব সহজভাবে করা যাওয়া কাজ গুলোকে কেমন যেন খুব কঠিন করে ফেলি। নবজাতককে জন্মের পরেই বুকের দুধ খাওয়ানো বলতে গেলে সবচেয়ে সহজ এবং সুমধুর কাজ। বাচ্চা জন্ম দেয়ার মতো কঠিন কাজের পর এই কাজটা যেন খরতাপের পর এক পশলা শান্তির বৃষ্টি।

আগস্ট মাসের ১ থেকে ৭ তারিখ বিশ্ব স্তন্যদুগ্ধ দ্বারা প্রতিপালন দিবস। ২০২৩ সালের ওয়ার্ল্ড ব্রেস্টফিডিং উইক এর প্রতিপাদ্য হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে স্তন্যদুগ্ধ পান করানোকে স্বাভাবিকীকরণ। কারণ যেসব নারীরা কাজে চলে যান, তারা নিরবিচ্ছিন্যভাবে ৬ মাস পর্যন্ত বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে পারেন না। অথচ এটা বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থার নির্দেশনার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

বাংলাদেশে এর চেয়েও গুরুতর “অনিয়ম” আছে যা উদ্বিগ্ন হওয়ার মত। এখানে হাসপাতাল গুলোতে বাচ্চার জন্মের সাথেসাথে মা’এর কাছে বাচ্চাকে না দিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় রুটিন চেকআপে। যেখানে একটা সুস্থ বাচ্চাকে “ক্যাংগারু কেয়ার” বা জন্মের সাথেসাথেই মায়ের বুকের উপর দিয়ে স্তন্যদুগ্ধ (কোলোস্ট্রাম) পান করতে দেয়ার সুযোগ করে দেয়া তার অধিকার।

কেন কোলোস্ট্রাম বা শালদুধের বিষয়ে এতো জোর দিচ্ছি?

তাহলে প্রথমেই কথা বলি মায়ের বুকে আসা প্রথম দুধ নিয়ে, যা আমরা কোলোস্ট্রাম বা শাল দুধ নামে জানি। এই পানি বা স্বর্ণালী রঙের তরল মায়ের বুকে থাকে গর্ভাবস্থায় এবং বাচ্চার জন্মের পর পর্যন্ত। বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থার মতে এই শাল দুধ হচ্ছে ‘বাচ্চার প্রথম টিকা’

টিকা আমরা বাচ্চাকে কেন দেই? যাতে বাচ্চার দেহে কোন একটি রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। শাল দুধকে বলা হচ্ছে ‘বাচ্চার প্রথম টিকা’। কারণ এতে আছে বাচ্চার অনেক রোগের প্রতিষেধক (২০০১)। বাচ্চা জন্মের পর প্রথম সপ্তাহগুলোতে সে অনেক ঝুঁকির মধ্যে থাকে। তার অনেক ধরণের রোগের আশংকা থাকে। এইসব রোগের ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে শাল দুধ টিকার মতো কাজ করে আলহামদুলিল্লাহ।

এমন অনেক বাচ্চাই আছে যারা কখনোই মায়ের দুধ পায়নি। তারা দিব্বি বেঁচে আছে কারণ মানুষ গর্ভের ভেতর থেকেই বেঁচে থাকার জন্য অনেক প্রতিষেধক নিয়ে আসে। কিন্তু শাল দুধ না খাওয়া বাচ্চার স্বাস্থের গুণমান কিছুটা কমই থাকে। শাল দুধ এবং পরবর্তিতে আসা পরিপূর্ণ দুধ জীবাণুকে বাচ্চার শরীরের নাজুক টিস্যুতে ঢুকতে বাঁধা দেয়। শাল দুধ এবং পরিপূর্ণ দুধ বাচ্চার অণুজীবগুলোকে মেরে ফেলতে এবং প্রদাহ থেকে বাঁচাতে সাহায্য করে। .

এছাড়াও বাচ্চার স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কাজ করার জন্য থাইমাস নামের যেই অঙ্গ কাজ করে তার স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। যেই বাচ্চাটা মায়ের বুকের দুধ না খেয়ে অন্যান্য দুধ খায় তার থাইমাস এর বৃদ্ধি স্বাভাবিক থাকেনা। সেই তুলনায় মায়ের বুকের দুধ খাওয়া বাচ্চার থাইমাস এর বৃদ্ধি স্বাভাবিক ভাবেই হতে থাকে এবং এতে বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়ে (হ্যানসন ২০০৪)।

জন্মের পর থেকেই মায়ের বুকের দুধ প্রতিটা বাচ্চার অধিকার। যেসব বাচ্চারা স্তন্যদুগ্ধ পান করেনা তারা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ঘাটতিতে ভুগে।

সুস্থ স্বাভাবিক বাচ্চার তো মায়ের বুকের দুধ পান করা প্রয়োজন, সেই সাথে বলতে হয় যে একটা ঝুঁকিতে থাকা বাচ্চার জন্য জন্ম থেকেই মায়ের বুকের দুধ প্রয়োজন। এটা বাচ্চার অন্ত্রের সুস্থতা বজায় থাকতে সাহায্য করে। এছাড়াও বাচ্চার আরও বিভিন্ন রোগের আশঙ্কা বা ঝুঁকি থেকতে বাঁচতে এক কথায় বুকের দুধ অত্যাবশ্যক জন্মের পর থেকেই।

‘ক্যাংগারু কেয়ার’ বা জন্মের সাথেসাথেই মায়ের বুকের উপর বাচ্চাকে দিয়ে স্তন্যদুগ্ধ (কোলোস্ট্রাম) পান করতে দেয়ার সুযোগ করে দেয়া হলে সেটা থেকে শুধু বাচ্চা-ই না, মা’ও উপকার লাভ করে।

দুধপান করানোর মাধ্যমে মায়ের শরীরে অক্সিটোসিন হরমোন প্রবাহিত হয় এবং প্লাসেন্টা সহজে বের হয়ে আসে। এবং মায়ের বুকের দুধ সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে আসতে সাহায্য করে।

এখন সময় এসেছে আমাদের মায়েদের নিজের এবং সন্তানের হিতে কথা বলার। নিজের বার্থ প্ল্যান করার সময় ডাক্তারের সাথে কথা বলে নেয়া, যাতে তিনি ক্যাংগারু কেয়ার করতে অনুমতি দেন এবং মায়ের বুকে বাচ্চাকে রেখেই সব রুটিন চেকাপ করেন।

তথ্যসূত্র

Breastfeeding Made Simple Book by Kathleen Kendall-Tackett and Nancy Mohrbacher

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা