সিরিজ ইনডেক্স
১. প্রথম পর্ব
২. দ্বিতীয় পর্ব
৩. তৃতীয় পর্ব
৪. চতুর্থ পর্ব
৫. পঞ্চম পর্ব
কারো একবার প্রল্যাপ্স হলে সেটা পুরোপুরি স্থায়ীভাবে সারানো সম্ভব হয়না। কিন্তু চেষ্টা করলে সম্পূর্ণ সিম্পটম মুক্ত থাকা যায় ইন শা আল্লাহ।
প্রল্যাপ্স ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে একটা মূলনীতি হল Intra-abdominal pressure এর ব্যাপারে সচেতন থাকা। আমাদের বুক-পেটের ভেতরের বাতাসের চাপ সঠিকভাবে বজায় না থাকার কারনে পেলভিক ফ্লোরে প্রেসার পড়ে প্রল্যাপ্সের সিম্পটম বেড়ে যায়। তাই নিচের টিপস গুলো খেয়াল করলে দেখবেন যে ম্যাক্সিমামই সঠিক intra-abdominal pressure বজায় রাখার উপর নির্ভরশীল।
১. প্রেগন্যান্সী আর পোস্টপার্টাম
i) ডেলিভারি আর লেবার নিয়ে জানা:
ডেলিভারি আর লেবার নিয়ে পড়াশোনা করুন, প্রিনেটাল কোর্স করুন। বাচ্চার পজিশান, লেবার সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখলে দীর্ঘ লেবার আর ফরসেপ/ভ্যাকুয়াম এসিস্টেড ডেলিভারির চান্স কমিয়ে আনা যায়। লেবারের সময়ে নিচে চাপ দেয়া যাবেনা, আগে থেকেই সঠিকভাবে পুশ করা/কিংবা চাপ দেওয়া শিখে নিতে হবে । অনেকক্ষেত্রে ডেলিভারীর পর প্রল্যাপ্স হয়ই, তবে এই পয়েন্টগুলো খেয়াল রাখলে প্রল্যাপ্সের সিভিয়ারিটি কম হবে ইন শা আল্লাহ্।
ii) লেবারের পুশিং স্টেজ:
প্রলাপ্স এড়ানোর জন্য পুশিং এ কয়েকটা জিনিস মাথায় রাখতে হবেঃ
- শুয়ে শুয়ে পুশ করা যাবেনা। অন্য যেকোন পজিশান যা পেলভিক আউটলেটে সবচেয়ে বেশি স্পেস তৈরি করে সেগুলো ট্রাই করতে হবে। দাঁড়ানো, স্কোয়াট, সাইড হয়ে শোয়া ইত্যাদি।
- Urge আসার আগেই পুশ করা যাবেনা। সার্ভিক্স ফুল ওপেন হওয়া সাথে সাথেই পুশ করতে বলা হয় অনেকসময়, যা ঠিক নয়। বাচ্চার মাথা এনগেজড হলে এবং মায়ের পুশ করার আর্জ আসলেই কেবল পুশ করবে। যথাযথ সময় দিলে পুশ করারও প্রয়োজন হবেনা ইন শা আল্লাহ, fetal ejection reflex এ বাচ্চা নিজেই বেরিয়ে আসবে।
- অনেক সময় দম বন্ধ করে জোরে নিচের দিকে চাপ দিতে বলেন ডাক্তার নার্সরা। এটা একদমই করা যাবেনা। এতে পেলভিক ফ্লোরে প্রচন্ড চাপ পড়ে। দম ছেড়ে পুশ করতে হবে।
- প্রনেটাল পিরিয়ডেই প্রপার ব্রিদিং মেন্টেইন করে পুশ করার প্র্যাকটিস করতে হবে মাকে।
- বাচ্চা পেটে optimal position এ থাকলে পুশিং স্টেজ সহজ আর দ্রুত হবে, তাই এ ব্যাপারে আগে থেকেই মাকে জ্ঞান রাখতে হবে।
iii) পোস্টপার্টাম রেস্ট:
ডেলিভারির পর প্রথম সপ্তাহ can make or break your prolapse situation.
এসময়ে যত বেশি সম্ভব সোজা হয়ে শুয়ে পা বালিশের উপরে তুলে রাখার চেষ্টা করবেন। এটা ইউটেরাসকে নিজ জায়গায় ফিরে আসতে সাহায্য করবে। দাঁড়িয়ে থাকা, কাজ করা, সিড়ি বেয়ে উঠানামা এসব করবেন না।
বিশ্বের অনেক কালচারেই postpartum confinement এর প্রচলন ছিল,এখনো কিছু রয়েছে। আমাদের দেশেও আতুড় ঘর প্রচলিত ছিল। এসব ক্ষেত্রে মাকে বেশ কিছুদিন বেড রেস্টে রাখা হয়, নানা রকম শক্তিবর্ধক খাবার দেয়া হয় এমনকি রেগুলার মাসাজও করা হয়। আজকাল এত কিছু পাওয়া না গেলেও অন্তত সাতদিন বেডরেস্টে থাকলে প্রল্যাপ্সের জটিলতা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা যায়।
পোস্ট পার্টাম পিরিয়ডে ঠিক মত সুষম খাবার খাওয়া আর পানি পান করা জরুরি। এসময় নিজের যত্ন না দিলে লং টার্মে অনেক বেশি ভুগতে হয়। তাই বাচ্চার পাশাপাশি নিজেরও যত্ন নেবেন।
iv) পোস্ট পার্টাম বেল্ট
ডেলিভারির পর বেল্ট পড়ার ব্যাপারে কিছু সতর্কতা বজায় রাখতে হবে। বেল্ট পড়লে পেটের ঝুলে যাওয়া প্রতিরোধ করা যায়-এটা একটা ভুল ধারনা। পেটের expanded মাসলকে সাপোর্ট দেয়া বেল্টের কাজ। বেল্ট পেটের ভেতরের অঙ্গকে সাপোর্ট দিচ্ছে নাকি এক্সট্রা চাপ তৈরি করছে তা খেয়াল রাখতে হবে। অনেকেই যথাসম্ভব টাইট করে বেল্ট পড়েন, এতে অভ্যন্তরীন অঙ্গসমূহ আর পেল্ভিক ফ্লোরে চাপ পড়ে। বেল্ট পড়তেই হলে এমনভাবে পড়া উচিত যেন পেলভিক ফ্লোরে চাপ না পড়ে।
২। এক্সারসাইজ
প্রল্যাপ্স ম্যানেজমেন্টে দুই ধরনের এক্সারসাইজ বা ব্যায়াম জরুরিঃ
- Pelvic Floor Strengthening- Kegel
- Core Muscle Strengthening
i) কেগেল:
পেল্ভিক মাসল (মাংসপেশী) শক্তিশালী করতে সব বয়সী মেয়েদের জন্য বেস্ট এক্সারসাইজ হল কেগেল। সারাদিনে যেকোন সময়ে করা গেলেও বেস্ট টাইম হল দিনের শুরুতে যখন মাংসপেশী ক্লান্ত থাকেনা। আর অবশ্যই সঠিকভাবে সঠিক মাসল ব্যবহার করছেন কিনা তা জেনে/বুঝে নেয়ার চেষ্টা করবেন।
কেগেলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানিনা – পেলভিক মাসল ঠিকভাবে রিল্যাক্স করতে পারা।
অনেকেই অবচেতনভাবে ভ্যাজাইনাল এরিয়ার মাসলগুলো টাইট করে রাখে। বিশেষ করে ডেলিভারির পরে। এভাবে পেলভিক ফ্লোর Hypertonic হয়ে যায়। যেকোন মাসলের জন্যই রিল্যাক্স করতে পারা জরুরি। চিন্তা করে দেখুন আমরা যদি টানা অনেক সিড়ি বেয়ে উঠি আমাদের পায়ের মাসল কত strained হয়ে যায়, এরপর রিল্যাক্স করতে না পারলে কি অবস্থা হত। তেমনি কেবল টাইট থাকলে এবং রিল্যাক্স করতে না পারলে পেলভিক মাসল আস্তে আস্তে কার্যক্ষমতা হারাতে থাকে। আর হাইপারটনিক পেলভিক ফ্লোরের জন্য কেগেল এক্সারসাইজ লাভের চেয়েও ক্ষতি বেশি করে। এতে ইনকন্টিনেন্স, ইন্টারকোর্সের সময় ব্যথা, কন্সটিপেশন আর পেলভিক পেইন হয়।
সবাই অবশ্যই অবশ্যই কেগেলের পাশাপাশি পেলভিক ফ্লোর রিল্যাক্সেশন এক্সারসাইজ করবেন। উপরন্তু কেগেল শুরুর আগে রিল্যাক্সেশন এক্সারসাইজ করে নিতে পারলে ভাল।
কেগেল নিয়ে মাতৃত্ব সাইটের আর্টিকেলঃ গর্ভকালীন ব্যায়াম
ii) কোর মাসল এক্সারসাইজ
আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোর মাসল- সহজভাবে বলতে পেটের মাসল স্ট্রেন্থেনিং এক্সারসাইজকে অপশনাল মনে করি, কিন্তু এটা প্রল্যাপ্স ম্যানেজমেন্টের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ছোট বাচ্চা, ঘর সংসার সামলিয়ে আমাদের অনেকের জন্যই বেশি সময় নিয়ে কয়েক ধরনের এক্সারসাইজ করা কঠিন। তাই সাজেস্ট করব বেসিক কিছু এক্সারসাইজ করতে, অল্প করে হলেও রেগুলারলি করতে।
দুটা ছোট ভিডিও লিংক দিচ্ছি । এছাড়াও ইউটিউব থেকে সুবিধামত ফুল ওয়ার্কাউট ভিডিও খুজে নিতে পারেন ইন শা আল্লাহ।
তবে কেগেল বাদে বাকি কোন এক্সারসাইজ ডেলিভারির পরপরই করা যাবেনা। ৬-৮ সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে।
এগুলোর পাশাপাশি আস্তে ধীরে হাটাহাটি করা বেশ ভাল একটা এক্সারসাইজ।
যখনই পেলভিক এরিয়াতে ভারী লাগবে বা প্রল্যাপ্স সিম্পট্ম বেশি অনুভূত হবে তখন বিছানা বা ফ্লোরে সোজা হয়ে শুয়ে দেয়ালে দুই পা তুলে রাখতে পারেন, চাইলে হিপের নিচে বালিশ দিয়ে উচু করে নিতে পারেন। এভাবে কিছু সময় থাকলে হেভিনেস কমে আসবে ইন শা আল্লাহ্।
৩। সঠিক Posture আর Breathing
শুনতে খুব সাধারন মনে হলেও প্রল্যাপ্স ম্যানেজমেন্টে এই দুটা ব্যাপার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক Intra-abdominal pressure বজায় রাখার জন্য সঠিক দেহভংগিমা আর নিঃশ্বাস মেন্টেইন করতেই হবে। আর তা করতে পারলে প্রল্যাপ্সের সিম্পটম প্রায় ৮০% কমিয়ে আনা যায় ইন শা আল্লাহ।
আমরা অনেকেই জানিনা যে আমরা shallow breathing এ অভ্যস্ত , এতে আমাদের ডায়াফ্রাম ঠিকভাবে প্রসারিত হয়না। তাই পেলভিক ফ্লোরে চাপ পড়ে। আবার আমরা দিনের বেশিরভাগ সময় slouched /কুজো হয়ে থাকি যার কারনে abdominal pressure এর অধিকাংশ ভারই পেলভিক ফ্লোরের উপর পড়ে।
ব্যাপারগুলো লিখে বুঝানো একটু কঠিন তাই ভিডিও লিংক এড করে দিচ্ছি
৪। কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation) নিয়ন্ত্রন করা
প্রল্যাপ্সের একটা মেইন কারন হল কন্সটিপেশন। প্রেগ্ন্যান্সি- পোস্টপার্টাম পিরিয়ডে তো এটা এক আতংকের নাম। প্রল্যাপ্স সিম্পটম কমাতে কন্সটিপেশন নিয়ন্ত্রণে আনতেই হবে। এছাড়া কোন উপায় নাই।
রেগুলার শাকসব্জি , ফলসহ ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার আর প্রচুর পানি পান করতে হবে। আর্লি পোস্টপার্টাম পিরিয়ডে অনেক সময় অষুধের প্রয়োজন হয়-কন্সটিপেশন যে পরিমানে ক্ষতি করে তার চেয়ে কয়েকদিন টানা অষুধ খাওয়া ভাল। এর পাশাপাশি সাজেশান হিসেবে খেজুর, ফ্লাক্স সিড, চিয়া সিড, দই, পেপে, ইসবগুলের ভুষি ইত্যাদি- যার যেটা কাজে লাগে সেগুলো খেতে হবে।
ইসবগুলের ভুষির ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রচুর পানি/লিকুইড খেতে হবে। ব্রেস্টফিডিং এর কারনে এম্নিতেই মায়েরা সহজে ডিহাইড্রেটেড হয়ে যায়, ওদিকে যথেষ্ট পানি না পেলে ভুষি পুপকে প্রচন্ড শক্ত করে ফেলে। তাই উলটো কন্সটিপেশন আরও বেড়ে যায়।
অনেকে টয়লেট করার জন্য চা কফি খান, খেয়াল রাখতে হবে যে এতে ব্লাডার irritated হচ্ছে কিনা। ব্লাডার প্রল্যাপ্সের একটা লক্ষন হল ঘন ঘন ইউরিন ইনফেকশানের মত জ্বালাপোড়া করা। ক্যাফেইন এটা বাড়ায়।
অনেকেরই হাইপারটনিক পেলভিক ফ্লোরের কারনে কন্সটিপেশন হয়। পেল্ভিক মাসল রিল্যাক্স করতে না পারলে সহজে টয়লেট বের হওয়া সম্ভব না। তাই রিল্যাক্সেশন এক্সারসাইজগুলো করতে হবে।
টয়লেট করার সময় অবশ্যই নিচে চাপ দেবেন না। দম ছেড়ে ট্রাই করতে হবে (অনেকটা ডেলিভারির সময়ের পুশ করার মত)। কুজো হয়ে বসবেন না। কমোড ইউজ করলে পায়ের কাছে টুল রাখার চেষ্টা করবেন বা প্যান ব্যবহার করবেন। ডেইলি একটা নির্দিষ্ট সময়ে টয়লেট করার জন্য শরীরকে অভ্যস্ত করতে পারলে ভাল।
৫। ভার বহন না করা
ডেলিভারির পর প্রথম ছয় সপ্তাহ ভারী কিছু বহন করবেন না। বাচ্চাকেও বিছানায় বসে কোলে নিবেন যথাসম্ভব।
পোস্টপার্টাম পিরিয়ড শেষেও কখনোই নিজের বাচ্চার চেয়ে ভারি কিছু বহন না করার চেষ্টা করবেন। যদি ভারী কিছু তুলতেই হয় বা বহন করতে হয় সেক্ষেত্রে KNACK টেকনিক এপ্লাই করতে হবে যাতে পেল্ভিক ফ্লোরে প্রেসার না পড়ে। Knack হল ভারি কিছু তোলার কিংবা হাচি/কাশি দেয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে দম ছেড়ে পেলভিক মাসল টাইট / contract করা। এতে হঠাত করে পেলভিক ফ্লোরে চাপ পড়বেনা। এ্টা করলে urine leakage থেকেও বাচতে পারবেন।
বাচ্চা বা অন্য কিছু বহনের ক্ষেত্রে এমনভাবে নিতে হবে যাতে ওজনটা পিঠে সমভাবে বন্টন হয়, মেরুদন্ড সোজা রেখে কোলে নিতে হবে। আমরা কলসী কাখে নেবার মত যেভাবে বাচ্চা নিই সেটা পেলভিক ফ্লোরের জন্য ভাল নয়।
একটা প্রল্যাপ্স ম্যানেজমেন্ট ডিভাইস বিদেশে বেশ প্রচলিত- pessary, দেশে পাওয়া যায় কিনা ডাক্তাররা বলতে পারবেন।
প্রল্যাপ্স সারানোর সার্জিকাল অপশান আছে. তবে জেনে রাখা ভাল যে সার্জারির পরেও উপরের conservative management ফলো করতে হবে। সার্জারির পর গর্ভধারন করা কঠোরভাবে নিষেধ, কেননা এতে সার্জারি ফেইল করে। আর এম্নিতেও প্রল্যাপ্স কারেকটিং সার্জারির ফেইলারের হার প্রায় ৪০%-৪৫%। অনেক ক্ষেত্রেই পুনরায় সার্জারি প্রয়োজন হয়।
উপরের টিপসগুলো যাদের প্রল্যাপ্স হয়েছে বা হয়নি, যারা মা হয়েছেন বা হননি -সবাই প্র্যাক্টিস করতে পারেন। এগুলোর মাধ্যমে মেনোপোজের পরে প্রল্যাপ্স এড়াতে পারবেন বা প্রল্যাপ্স হলেও এগুলোর মাধ্যমে সিম্পটম কমিয়ে আনতে পারবেন ইন শা আল্লাহ। একটু সময় বেশি লাগলেও ভিডিওগুলো দেখে নিবেন।
লেখাটি রিভিউ করেছেন –
ডাঃ মাশরুরা মাহজাবিন
MBBS
General Practioner, Trained Mental health counselor